লাম্বার স্মৃতিচিহ্ন নেই, কিছু স্মৃতি আছে

in life •  7 years ago  (edited)

7e28040aae363f44d082a8229942bc26-5a91981579a60.jpg
রমন লাম্বা (১৯৬০-১৯৯৮)

কারো হৃদয়ে যখন রক্তক্ষরণ হয়, সেটি তার একান্তই নিজস্ব। আমরা দেখতে পারি না। বুঝতেও কি পারি? বেশির ভাগ সময়েই উত্তর ‘না’। যে যার বুকের মধ্যে ক্ষরণটা বয়ে নিয়ে চলে। শুধু ক্ষরণ নয়, হয়তো তীব্র দহনও। কিন্তু সেই রাতে বুঝেছিলাম কিম লাম্বা এতক্ষণ যে বাধ-টাধ দিয়ে ক্ষরণ আটকে রেখেছিলেন, তা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। চুরমার বলেই আমার সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তিনি তখন উন্মত্ত। কী তাঁর রণরঙ্গিনী মূর্তি!
২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৮। রমন লাম্বাকে সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (তৎকালীন পি জি হাসপাতাল) নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে আনা হয়েছে একটি বেসরকারি ক্লিনিক থেকে। লাইফ সাপোর্টে আছেন। টিক টিক করে চলছে তাঁর জীবনের গতি। হয়তো চলছেও না। ছুটির দিন। তবুও পেশাগত দায়বদ্ধতা থেকেই হাসপাতালে খোঁজ-খবর নিতে যাওয়া। জালাল ভাই ছিলেন সেখানে, জালাল ইউনুস-আবাহনীর ক্রিকেট কমিটির সেই সময়ের সাধারণ সম্পাদক। তাঁর অনুমতি সাপেক্ষে আইসিইউতে রমন লাম্বার দিকে তাকাতেই হৈ হৈ করে ছুটে এলেন এক বিদেশিনী। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তিনি আরও ক্ষিপ্ত। পাশের টেবিলে কাগজপত্র চাপা দেওয়া পেপার-ওয়েটটা ছুড়ে মারলেন ‘বডি লাইনে’। ঠিক ঠিক ‘ডাক’ করতে পেরেছিলাম বলে বাঁচোয়া। আমার মাথা ফাঁকি দিয়ে কাচের পিণ্ডটা গিয়ে লাগল কাচের দরজার স্টিলের কাঠামোয়। দরজার বাইরে বেরিয়ে আসার পরও লাম্বার আইরিশ স্ত্রীর চিৎকার কানে বাজছিল, ‘গেট আউট’, ‘গেট আউট’! এই উন্মত্ত আচরণের কারণটা আজও আমি খুঁজে ফিরি। উপলব্ধি, কিম ধরতে পেরেছিলেন ২০ ফেব্রুয়ারি আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনায় আঘাত পাওয়া তাঁর প্রিয়তম স্বামীকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য যা যা করা হয়েছে তার মধ্যে কোথাও একটা গলদ ছিল। সাংবাদিকেরা সত্যটা তুলে ধরেনি!
গলদ তো ছিলই। প্রথমত আবাহনীর খেলোয়াড় বা কর্মকর্তারা চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহামেডানের বিপক্ষে জয়ের নেশায় এতটাই বুঁদ ছিলেন যে তাঁরা আঘাতের গুরুত্বই বুঝতে পারেননি। গুরুত্ব যখন বোঝা গেল, তখন দেরি হয়ে গেছে অনেক।
হেলমেটহীন লাম্বা ফিল্ডিং করতে দাঁড়িয়েছিলেন ফরোয়ার্ড শর্ট লেগে। বাঁহাতি স্পিনার সাইফুল্লাহ খানের খাটো লেংথের বলটিতে সজোরে পুল করেছিলেন মোহামেডানের ব্যাটসম্যান মেহরাব হোসেন। সেটি লাম্বার বাঁ কানের পাশে লেগে হাওয়ায় ভেসে থাকে কিছুক্ষণ। আবাহনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত অধিনায়ক ও উইকেটকিপার খালেদ মাসুদ অনেকটা বাঁদিকে সরে এসে ক্যাচ নেন। লিগে আবাহনীর গুরুত্বপূর্ণ জয়ের পথে গুরুত্বপূর্ণ একটি উইকেট নেওয়ার উদযাপনের মধ্যে দেখা গেল, লাম্বা পড়ে আছেন পিচের পাশে। তারপর দলীয় চিকিৎসক ডা: জাওয়াদের কাঁধে ভর দিয়ে হেঁটে হেঁটেই যান ড্রেসিংরুমে। সেখান থেকে হাসপাতালে নিতে দেরি হয়ে যায় খানিকটা। বমি করেন ড্রেসিংরুমেই। ধানমন্ডির ডেল্টা ক্লিনিকে যেতে যেতে তিনি সংজ্ঞাহীন। তারপর গভীরভাবে অচেতন। অবশেষে সব শেষ। চিররহস্যময় অন্য ভুবনের বাসিন্দা। দেয়ালের ছবি আর ক্রিকেটের পরিসংখ্যান বইয়ে কতগুলি বোবা অঙ্ক। চার টেস্ট, ৩২টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা এক ক্রিকেটার। ভারতীয় ক্রিকেটে এসেছিলেন অনেক প্রতিশ্রুতি নিয়ে। শেষ পর্যন্ত নিতান্তই ভাড়াটে ক্রিকেটার, যিনি খেলে বেড়িয়েছেন আয়ারল্যান্ড-বাংলাদেশের ক্লাব ক্রিকেটে। ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৮-এর দুপুরে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে চিকিৎসক যখন লাম্বার প্রাণসংহারী সব যন্ত্র খুলে নেন, তাঁর বোন ভিকি বিলাপ করে কাঁদছিলেন, ‘ও এখানে এসেছিল ক্রিকেট খেলতে.... ।’ সময় যেন পাখির ডানায় উড়ে চলে। দেখতে দেখতে ২০ বছর হয়ে গেল, লাম্বা নেই। কিন্তু এখনো মনে হয় যদি সময়মতো সুচিকিৎসা দেওয়া যেত, মাত্র আটত্রিশেই শেষ হয়ে যেত না তাঁর জীবন। দেখে যেতে পারতেন ক্রিকেটে বাংলাদেশের উত্থান। অর্জুনা রানাতুঙ্গারা গর্ব করে বলেন, শ্রীলঙ্কা থেকে ঢাকায় এসে তাঁরা ক্লাব ক্রিকেট খেলেছিলেন বলে বাংলাদেশের ক্রিকেট এগিয়েছে। এমন দাবি করার প্রথম অধিকার কিন্তু রমন লাম্বার। তিনিই এ দেশের প্রথম বিদেশি মহাতারকা। রাশি রাশি রান করে, দলকে ট্রফি জিতিয়ে তারকার সম্মান যেমন ধরে রাখতে পেরেছিলেন, তেমনি বাংলাদেশের ক্রিকেটে নতুন একটা হাওয়াও বইয়ে দিয়েছিলেন। আটত্রিশেও ঢাকার মাঠে এসেছিলেন তারুণ্যদীপ্ত ক্রিকেটের বিজ্ঞাপন হয়ে। তাঁর মৃত্যুর পর ভারতের ক্রিকেট লেখক বিজয় লোকপল্লী তাঁর সম্পর্কে যথার্থই লিখেছিলেন, ‘তাঁর গায়ে সবসময় থাকত তারুণ্যের বেশ, চিন্তায় ছিলেন তরুণ, খেলতেন তরুণের মতো। হায়, তাঁর মৃত্যুও হলো তারুণ্যে!’
62b29e8d2971e2e51abe9f4c281e426e-5a91981576096.jpg
রমন লাম্বা

এ দেশে ক্রিকেট খেলতে এসে মৃত্যু, কিন্তু লাম্বার স্মৃতিচিহ্ণ কোথাও নেই। না বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে, না আবাহনী ক্লাবে। একটি ছবি পর্যন্ত নেই। মৃত্যুর ২০ বছর পূর্তির দিন গত ২৩ ফেব্রুয়ারি আবাহনী তাঁর নামটি পর্যন্ত মুখে আনেনি। আবাহনীর ক্রিকেট সম্পাদক ইসমাইল হায়দার মল্লিকের কাছে জানতে চাওয়া হলো, ‘রমন লাম্বার স্মরণে কিছু কি করেছেন ক্লাবের পক্ষ থেকে?’ মল্লিক বললেন, ‘দাঁড়ান, দাঁড়ান ক্লাবে একটু খোঁজ-খবর করে দেখি।’ খোঁজ-খবর করে ‘না’ ছাড়া কিছু বলতে না পেরে মোবাইলে কনফারেন্সে ধরিয়ে দিলেন আবাহনীর কর্মকর্তা জালাল ইউনুসকে, যাঁর চোখের সামনে মৃত্যু হয়েছে লাম্বার। হতাশাই ছিল জালাল ইউনুসের কণ্ঠে, ‘এটা লজ্জাজনক। কিছু করা উচিত ছিল রমনের জন্য। নতুন যে ক্লাব ভবন হচ্ছে, সেখানে হয়তো তাঁর ছবি রাখব আমরা। কিমের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেখব কিছু করা যায় কি না!’ আবাহনী আসলে এরকমই। খানিকটা অকৃতজ্ঞ এবং অনেক বেশি বিস্মৃতিপরায়ণ। ক্লাবের নায়কদের স্মরণের উজ্জ্বল আলোয় ধরে রাখার কোনো চেষ্টা কর্তৃপক্ষের দেখা যায় না। এদেশেরই তারকা মোনেম মুন্না-রবিউদ্দিন রবিদের নামই যখন বিস্মৃতির পথে যাত্রা শুরু করে, তখন রমন লাম্বার জায়গা কোথায়?
লাম্বার মৃত্যুর পর বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল তাঁর নামে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের একটি বোলিং প্রান্তের নামকরণ হবে। সময়ের হাতে সেই সিদ্ধান্ত সঁপে দেওয়া হয়। তারপর তো স্টেডিয়াম থেকে ক্রিকেটের পাটই গেছে চুকে। এতে একটা কাজ হয়েছে, দেশের বিভক্ত রাজনীতির মারপ্যাঁচটা এড়ানো গেছে। একজন ভারতীয় ক্রিকেটারের নাম খোদাই করার দায়ভার কারো ওপর চাপেনি!
লাম্বার যেখানে উজ্জ্বলতম স্মৃতি হয়ে থাকার কথা সেখানেই আছেন। আছেন স্ত্রী কিমের হৃদয়ে, দুই সন্তান জেসমিন ও কামরানের আবছা স্মৃতিতে। ভারতে নয়, আয়ারল্যান্ডে নয়, অন্য কোথাও হৃদয়ের প্রশান্তি নিয়ে থাকতে চেয়েছিলেন কিম। দুই সন্তানকে নিয়ে থিতু হয়েছেন পর্তুগালের মাদেইরাতে। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর রাজ্যে। সেখানে ভ্রমণবিষয়ক ব্যবসায় জড়িয়েছেন, মেয়ে ২৫ বছর বয়সী জেসমিন প্রধান সহযোগী। ২৩ বছর বয়সী ছেলে কামরান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। লাম্বার দেওয়া একটি ধাতব মুদ্রা সব সময় মানিব্যাগে নিয়ে ঘোরেন কিম, আর তাঁর বিছানার নিচে থাকে লাম্বার প্রিয় একটি ক্রিকেট বল। দুই বছর আগে একটি ভারতীয় পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কিম বলেছিলেন, ‘ক্ষতটা খুব গভীর, শূন্যতা বিশাল।’
এদেশেরও একজনকে লাম্বার স্মৃতিটা তাড়িয়ে বেড়ায়-মেহরাব হোসেন। প্রতিটি ফেব্রুয়ারি মাসের নির্দিষ্ট দুটি দিনে ঠিকঠাক ঘুমোতে পারেন না মেহরাব। ঘুমোতে গেলেই বাংলাদেশের সাবেক এই ক্রিকেটারের চোখে ভাসে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের সেই দুর্ঘটনা, আর কফিনে ঢাকা লাম্বার মুখ।
লাম্বার স্মৃতিচিহ্ন হয়তো ধরে রাখা হয়নি। তবে নিশ্চিত করেই কিছু স্মৃতি বুকে ধরে রেখেছে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের সবুজ ঘাস।
কিছু স্মৃতি জমিয়ে রেখেছে আবাহনী ক্লাবের একখণ্ড জমি। যেখান থেকে কফিনবন্দী হয়ে লাম্বা ফিরে গিয়েছিলেন দিল্লিতে, নিজের বাড়িতে!
Source: Pobitro Kundu, Prothom Alo
#miloha

Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!