একটি মেয়ের গল্প

in love •  6 months ago  (edited)

আমি এক মেয়েকে চিনতাম যে ভার্সিটি লাইফে আরাম আয়েশ, মৌজ মস্তিতে জীবন না কাটিয়ে বিয়ের জন্য টাকা জমাতো। মেয়েটা ছিলো আমার রুমমেট। ইডেন কলেজে ক্যামেস্ট্রি নিয়ে পড়া এই মেয়েটা রোজ সকালে উঠে গ্রিন রোড থেকে ইডেন পর্যন্ত হেটে যেত দশ টাকা বাঁচানোর জন্য। অথচ কেউ জিজ্ঞেস করলে হাসিমুখে বলতো, মুটিয়ে যাচ্ছিতো তাই হেটে যাই। কিন্তু আমি জানি সে অনাহারে থেকেও টাকা জমিয়ে যাচ্ছে বিয়ের জন্য।
মেয়েটার নাম ছিলো শান্তা। নামের মতো শান্ত শিষ্ট এই মেয়েটি প্রেম করতো ঢাকা ইউনিভার্সিটির এক ছেলের সাথে। শান্তার মুখেই শুনেছি ছেলেটা ওর পাশের গ্রামে থাকতো। শান্তাকে দেখতে রোজ ছুটে আসতো কলেজ ছুটির সময়। এরপর ছেলেটা ঢাকায় এসে ভর্তি হয়। বছর দুই বাদে শান্তাও আসে ইডেনে ভর্তি হয়ে। শান্তার ফ্যামিলির আর্থিক অবস্থা মোটামুটি। প্রতিমাসে ওকে একটা খরচ পাঠায়, ও নিজেও টিউশনি করিয়ে ভালো টাকা রোজগার করতো তবুও দিনাতিপাত করতো চাপিয়ে চাপিয়ে।

couple-437968_1280.jpg

সপ্তাহে একদিন মাংস কিনে সেটা রান্না করে সিংহভাগই নিয়ে যেত এই প্রেমিক পুরুষ টির জন্য। কখনো কখনো নিজের জন্য এক টুকরোও রাখতো না। আবার আফসোস করে বলতো,
"বুঝলি তোর ভাইয়া হলের মাছ মাংস খায় না। একটু শুচিবায়ু আছে তো তাই। সারা সপ্তাহ অপেক্ষা করে থাকে আমার হাতে খাবে বলে।
শান্তার প্রেমিক ছেলেটি বিসিএস এর জন্য দিন রাত এক করে প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। আর শান্তা দিনরাত এক করে টাকা জমানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিলো। সারাদিন ক্লাস, টিউশন, কোচিং এর পর রাতে এসে খাতা লিখতো কিছু টাকা পাবার আশায়।
একবার শান্তা অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় আমি খুব বকেছিলাম। তখন ও লাজুক গলায় বলল, " আমার খুব শখ বিয়ে অনেক ধুমধাম, আয়োজন করে করবো। যেন সবাই বলে, দেখ ওই শান্তার বিয়ে হচ্ছে। এরকম বিয়ে আজকাল দেখা যায় না।
শান্তার এই পাগলামি কে হোস্টেলের সবাই উড়িয়ে দিতো। কিন্তু আমার কাছে ভীষণ ভালো লাগতো। মেয়েটা নিজের শখ, ইচ্ছে পূরনের জন্য কারও উপর নির্ভর করে থাকছে না। নিজেই চেষ্টা করছে। আমার খুব ভালো লাগতো ওকে দেখে।
আড়ম্বরহীন ভাবে একদিন শান্তার বিয়ে হয়ে গেল। এক সকালে এসে আমার ঘুম ভাঙিয়ে বলল, "আজ আমরা বিয়ে করছি"।
আমি চোখ কচলে শান্তার দিকে তাকাই। শান্ত, স্নিগ্ধ চোখ মুখে হাসি আনন্দ ঝলমল করছে। ছোটবেলায় ঈদের নতুন জামা প্রথম দেখলে যেমন আনন্দ হয় তেমন আনন্দ সেদিন আমি শান্তার চোখে দেখেছিলাম।
শান্তার বিয়েতে আমিও ছিলাম। ছেলেটা হঠাৎ ছোট একটা চাকরি পেয়ে গেল তাই আর দেরী করতে চাইলো না। কোনোরকম আয়োজন ছাড়াই কবুল পড়ে বিয়ে করে নিলো।
শান্তার স্বামীকে দেখে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। কালো বে/টে,মো/টা একটা ছেলের জন্য শান্তা এতো পাগল ছিলো! আমি আড়ালে নিয়ে শান্তাকে বললাম, "মরার প্রেম তোকে একদম অন্ধ করে দিয়েছে"?
শান্তা আমার গলা জড়িয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলেছিল, এরকম প্রেম তোর জীবনেও আসুক। তখন বুঝবি। আমি বুঝেছিলাম,এ প্রেম শান্তাকে অনেক টা স্রোতের মতো ভাসিয়ে নিয়েছিল বলেই তার ধুমধাম করে বিয়ে করার শখ টাও কর্পুরের মতো উবে গেছে।
জীবন জীবনের নিয়মে চলে যায়। কিন্তু ঠিকই একদিন আমার জীবনে মরার প্রেম সত্যিই এসেছিলো।
ছেলেটা ছিলো আসিফ। ইউনিভার্সিটির রবিন্দ্র জয়ন্তীতে আমার গান শুনে গুনমুগ্ধ এই প্রেমিক রোজ বিকেলে অফিস শেষে আমাকে দেখতে আসতো। আমি তখন লাইব্রেরী যেতাম পড়তে। কাছের বান্ধবীটি ফিসফিস করে বলতো, দেখ রোদে পুড়ে চেহারার কী অবস্থা বানিয়েছে তবুও প্রেয়সীর মন পায় না। কেন যেন হঠাৎই আমার মন গলে যায়। এক বিকেলে নিজেই রিকশা করে ঘুরতে গেলাম আসিফের সাথে। রবিন্দ্রোসরোবরে সেদিন শুধু ও বলছিলো আর আমি শুনছিলাম। ফেরার সময় বলল, একদিন কিন্তু গান শোনাবেন। ওই যে ওই গান টা "তোমার খোলা হাওয়ায়"।
এরপর রোজ নিয়ম করে রিকশায় শহুরে বাতাস গায়ে মেখে ঘুরে বেড়াতাম। হঠাৎ হঠাৎ তখন মনে পড়ে যেত শান্তার কথা। শান্তার স্বামী টিকে তখন আর খারাপ লাগতো না। বরং কল্পনায় ওদের খুনশুটি, মান, অভিমানের সংসার দেখতে পেতাম।
কিন্তু শান্তার সাথে আর যোগাযোগ হয় নি। ফোন হারিয়ে শান্তাসহ অনেকেই জীবন থেকে হারিয়ে গিয়েছিল।
গ্রাজুয়েশন শেষ হওয়ার পর ফ্যামিলির মত নিয়ে আসিফ কে বিয়ে করে নিলাম। বিয়ের পরের জীবন টা কে আমার কাছে বেশ কঠিন লাগলো। মানুষের মন জুগিয়ে চলা যে কতো কঠিন সেটা হাড়েমজ্জায় টের পেলাম। অথচ এই আমি যখন গুছিয়ে ছোটবেলায় পুতুল খেলতাম তখন সবাই বলতো এই মেয়ের একদিন সোনার সংসার হবে। সংসার সামলাতে গিয়ে টের পেলাম পুতুল খেলা যত সহজ সংসার তত সহজ নয়। একটু কিছু ভুল হলে পুতুল ভুল ধরতে আসে না, কথা শোনায় না। কিন্তু সংসারে সেটা হবে।
একসময়ের গুনমুগ্ধ প্রেমিক আর বিয়ের পরের স্বামী বেচারা বলতে লাগলো, সবার বউ চাকরি করছে আর তুমি প্লেট ভর্তি করে ভাত খেয়ে মোটা হচ্ছো।
দেয়ালে আত্মসম্মানের পিঠ ঠেকে যাওয়ায় নেমে পড়লাম চাকরির খোঁজে। ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গেছিল। এমনকি সংসারের যাতাকলে পিষে ভুলেও যেতে বসেছিলাম যে আমি ক্যামিস্ট্রির মতো এক কাঠখোট্টা বিষয় কে রাতের পর রাত জেগে অনুধাবন করে পরীক্ষা দিয়েছিলাম।
নেমে পড়লাম অস্তিত্বের লড়াইয়ে। সেরকম ই একদিন শান্তার সাথে আমার দেখা হলো। চাকরির ইন্টারভিউ দিয়ে বাসে করে বাড়ি ফিরছিলাম তখনই পরিচিত কন্ঠস্বর ডেকে উঠলো, ঝুমু না?
আমি শান্তাকে দেখে আঁতকে ওঠা গলায় বললাম, শান্তা তুই? এই অবস্থা কেন!
শান্তা মলিন মুখে হেসে বলল, তোর এই অবস্থা কেন? রোজ রাতে ফেসপ্যাক ঘসে মুখের চামড়া মসৃন করা মেয়েটার মুখ এতো বুড়িয়ে গেল!
আমি মৃদু হেসে বললাম, তোর কথামতো এ কঠিন প্রেম ঠিকই এসেছিল কিন্তু সেটা সহ্য হয়নি তো তাই....
শান্তা উদাস গলায় বলল, মেয়েরা যখন প্রেমে পড়ে, ভালোবাসে তখন তাদের কাছে জীবন টা কে রুপকথার গল্পের মতো মনে হয়। কিন্তু রুপকথা বলে মেয়েদের জীবনে কিছু হয় না। যা হয় সেটা হলো অরুপকথা।
শান্তার নেমে যাওয়ার সময়ে আমি ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, তোর কথা তো বললি না? তোর স্বামী? বাচ্চাকাচ্চা?
শান্তা গলা খাদে নামিয়ে বলল, তুই হোস্টেল ছাড়ার পর পর ই আমি ফিরে এসেছিলাম। খালি হাতে এসেছিলাম জানিস! অথচ সংসারের সব জিনিস আমার জমানো টাকায় কেনা ছিলো তবুও ফেরার সময় কপালে একটা কাপড়ের টিপপ পর্যন্ত পরে আসতে পারিনি।
ভালো প্রেমিক যে হয় সে কোনোদিন ভালো স্বামী হয় না।
শান্তা বাস থেকে নেমে গিয়ে ভীড়ের মধ্যে হারিয়ে যায়। আমার কানে তখন শান্তার বলা কথা বাজতে থাকে। "মেয়েদের জীবনে কোনো রুপকথার গল্প হয় না। যা হয় তা হলো অরুপকথার গল্প।

Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!