মাদাম তুসো: মোমের ভাস্কর্যের জাদুকর 😲steemCreated with Sketch.

in news •  7 years ago 


যুক্তরাজ্যের লন্ডনে অবস্থিত এই জাদুঘরে প্রবেশ করলেই যেন থমকে যেতে হয়। পছন্দের তারকাদের সারি দেখে নিজের চোখকেও অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়। স্বপ্নের তারকা লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও, রুপালী জগতের তারকা রবার্ট প্যাটিনসন, শাহরুখ খান, ঋত্বিক রোশন কিংবা মাধুরী দীক্ষিত। শার্লক হোমস কিংবা স্পাইডারম্যানকে খুঁজে পাওয়াও অসম্ভব কিছু না এখানে। সহজেই দেখা মিলবে বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন কিংবা বিশ্বসেরা ফুটবলারদের একজন মেসিরও। একসাথে এত নক্ষত্রের সাক্ষাৎ পাওয়া যেন স্বপ্নের মত। স্বপ্ন পূরণের জাদুর এই ঘর মাদাম তুসো জাদুঘরনামে পরিচিত। তবে এরা কেউ রক্তে-মাংসের মানুষ নন, মোমের তৈরি পুতুল, যেখানে প্রবেশের পর পুতুলের পাশে সত্যিকার তারকাকে দেখলেও বুঝে ওঠা কঠিন কে মানুষ আর কে মোমের ভাষ্কর্য।

মোম দিয়ে তৈরি জনপ্রিয় ও বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের মূর্তির এই জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা মাদাম তুসো ছিলেন একজন ফরাসী মহিলা, যার আসল নাম ‘আনা মারিয়া গ্রোশোল্জ‘। ১৭৬১ সালের ১ ডিসেম্বর ফ্রান্সের স্ট্রবার্গে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। দুর্ভাগ্যবশত, জন্মের দুই মাস পরেই এক যুদ্ধে তার বাবা জোসেফ গ্রোশোল্জ নিহত হন। আর্থিক অবস্থাও বিশেষ ভালো ছিল না তাদের। বাবার মৃত্যুর পর মাতা এ্যানি ম্যারি ওয়াল্দারের সাথে সুইজারল্যান্ডের বার্নে চলে আসেন আনা। সেখানে একজন চিকিৎসকের বাড়িতে গৃহ পরিচারিকার কাজ নেন তার মা। ডাক্তার ফিলিপ কার্টিসের সহযোগিতায় সুইস নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন উভয়েই।

ফিলিপ মোমের মূর্তি তৈরিতে পারদর্শী ছিলেন। তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রে শব ব্যবচ্ছেদ শিক্ষায় এগুলোকে ব্যবহার করতেন মূর্তিগুলোর প্রতিকৃতি অঙ্কন করে। ছোট্ট আনার সাথে তার সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেখান থেকেই মূর্তি তৈরির হাতেখড়ি হয় আনার। ডা. ফিলিপ আনাকে মোমের মূর্তি তৈরির প্রশিক্ষণ দেন, আনাও এই শিল্পে তার মেধা ও প্রতিভার পরিচয় দেন দক্ষতার সাথে।

১৭৬৫ সালে ডা. ফিলিপ ‘ক্যাবিনেট ডি সিরে’ বা মোমের প্রদর্শনীর উদ্দেশ্যে প্যারিসে আসেন, সেখানে তিনি ফ্রান্সের সম্রাট পঞ্চদশ লুইসের শেষ উপপত্নী ‘মাদাম দু ব্যারী’র মোমের ভাষ্কর্য তৈরী করেন। ফিলিপের এই ভাষ্কর্যটিই বর্তমানে মাদাম তুসো জাদুঘরে প্রাচীনতম ভাষ্কর্য হিসেবে প্রদর্শিত হচ্ছে। ১৭৬৭ সালে আনা ও তার মা ফিলিপের সাথে কাজে যোগ দেন। সেখানে তিনি কাজের দক্ষতায় বিপুল প্রশংসা অর্জন করে।

এই সাফল্যের পর ১৭৭৭ সালে তিনি সর্বপ্রথম সম্পূর্ণ নিজস্ব প্রচেষ্টায়জঁ জাক রুশোর‘ মোমের প্রতিকৃতি তৈরি করেন এবং সফল হন। পরবর্তীতে আরো কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মোমের মূর্তি তৈরি করে তিনি তার অপূর্ব সৃষ্টিশৈলীর পরিচয় দেন। তার তৈরি শিল্পের মধ্যে ‘ভলতেয়ার’ এবং ‘বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

১৭৮০ থেকে ১৭৮৯ সালে চলা বিপ্লবে আনা সম্রাট চতুর্দশ লুইয়ের বোন এলিজাবেথকে মানসিকভাবে সহায়তা করেন। ফলে রাজ পরিবারের সদস্যেরা তার কাজে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে ভার্সেইয়ে আমন্ত্রণ জানান এবং আনা তাদের সহযোগিতায় সেখানে বসবাস শুরু করেন।

প্যারিসে ফরাসী বিপ্লব শুরু হলে তিনি সেখানেও বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। এ উদ্দেশ্যে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট এবং রোবসপিয়ের সাথে তার সাক্ষাৎ ঘটে। পরবর্তীতে তিনি ‘সন্ত্রাসের রাজত্ব’ চলাকালীন সময়ে জোসেফিন ডি বিউহারনাইসের সাথে গ্রেফতার হন এবং তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের জন্য গিলোটিন প্রস্তুত করা হয়। কিন্তু ডা. কুতিয়া ও তার পরিবারের সহায়তায় তিনি মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই পান এবং কিছুদিন পরেই মুক্তি লাভ করেন।

এরপর তিনি গিলোটিনে নিহত ব্যক্তিদের মুখোশ তৈরিতে নিয়োজিত হন এবং তার তৈরি বিখ্যাত ব্যক্তিদের মুখোশ বিপ্লবে বিভিন্ন শোভাযাত্রা ও মিছিলে তুলে ধরা হতো। সেখানেই এই অভিনব পদ্ধতিতে প্রতিবাদে তার শিল্পের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়।

১৭৯৫ সালে ফ্রঁসোয়া তুসোকে বিয়ে করেন এবং তিনি মাদাম তুসো নামধারণ করেন। সাংসারিক জীবনেও তিনি স্বচ্ছলতা পাননি। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দুই সন্তানের জন্ম দেন- জোসেফ এবং ফ্রাঁসোয়া।

১৭৯৪ সালে ডা. ফিলিপের মৃত্যুর পূর্বসময়ে তিনি তার মোমের মূর্তিগুলো মাদাম তুসোকে দান করেন। পরবর্তী ৩৩ বছর তিনি মূর্তিগুলো নিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রদর্শনীর জন্য নিয়ে ঘুরে বেড়ান। ১৮০২ সালে মূর্তিশিল্পের অগ্রদূত পল ফিরিডোরের আমন্ত্রণে মাদাম তুসো তার চার বছরের সন্তান জোসেফকে নিয়ে লন্ডনে যান। সেখানে লিশিয়াম থিয়েটারে তার কারুকার্যের প্রদর্শনী হয়। তবে লাভের অর্ধাংশ পল ফিরিডোরই নিয়ে যান। ফলে আর্থিক অবস্থার তেমন উন্নতি ঘটে না তাদের। উপরন্তু চরম আর্থিক সংকটের দরুন তিনি আর ফ্রান্সে ফিরে যেতে পারেননি। ১৮২১-২২ সালে তিনি মূর্তির সংগ্রহশালা নিয়ে গ্রেট ব্রিটেন এবং আয়ারল্যান্ডের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ান, সেখানে তার অপর ছেলে ফ্রাঁসোয়াও তাদের সাথে যোগদান করেন।

এরপর ১৮৩১ সালের দিকে স্বল্প সময়ের জন্য বেকার স্ট্রিট বাজার ভবনের উপরতলা ভাড়া নেন, যা বেকার স্ট্রিটের পশ্চিম পার্শ্বে এবং ডোরসেট স্ট্রিট ও কিং স্ট্রিটের মধ্যবর্তী এলাকায় অবস্থিত। ১৮৩৪ সালে সেখানেই তিনি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেন যা বর্তমানে ‘মাদাম তুসো জাদুঘর’ নামে পরিচিত। ১৮৩৫ সালের দিকে বেকার স্ট্রিটের ঐ ভবনই প্রথম স্থায়ী নিবাস হিসেবে পরিণত হয় মাদাম তুসোর।

জাদুঘরের সবথেকে আকর্ষণীয় ছিল ‘ভৌতিক কক্ষ’, যেখানে ফরাসী বিপ্লবে মৃত ঘাতক ও খুনি সহ বিপ্লবে নিহত ব্যক্তিদের মূর্তি প্রতিষ্ঠিত ছিল। ভৌতিক কক্ষ সর্বপ্রথম পাঞ্চ ম্যাগাজিনে ব্যবহৃত হলেও তুসো দাবী করেন নামটি তার নিজের দেওয়া এবং জাদুঘরের প্রচারণার জন্য ১৮৪৩ সালে তিনি এই নামটি ব্যবহার করেছিলেন।

১৮৩৫ সালে তিনি প্রথম নিজ ভবনে মোমের মূর্তি প্রদর্শনী শুরু করেন। ১৮৩৮ সালে তিনি আত্মজীবনী লেখেন এবং ১৮৪২ সালে তিনি নিজের একটি মোমের মূর্তি তৈরি করেন যেটা এখনো জাদুঘরের সম্মুখে প্রদর্শিত রয়েছে। ১৮৫০ সালের ১৬ এপ্রিল, ৮৮ বছর বয়সে ঘুমের মাঝেই মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

বর্তমানে লন্ডনে পর্যটকদের কাছে মাদাম তুসো জাদুঘরটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তবে লন্ডন ছাড়াও পৃথিবীর বেশ কিছু দেশে এর শাখা গড়ে উঠেছে। ১৯৭০ সালে আমস্টারডামে, ১৯৯৯ সালে লাস ভেগাসে, ২০০০ সালে নিউ ইয়র্ক সিটিতে, ২০০৬ সালে হংকং ও সাংহাইয়ে, ২০০৭ সালে ওয়াশিংটন ডি.সিতে, ২০১০ সালে ব্যাংককে এবং ২০১৪ সালে বার্লিনে এই জাদুঘরের শাখা গড়ে ওঠে।

প্রতিটি জাদুঘরে অবস্থিত অপূর্ব নিখুঁত এসব মূর্তি তাক লাগিয়ে দেয় যেকোনো মানুষকে। প্রতিটি মূর্তি তৈরিতে সময় লাগে চার মাসের অধিক। লাল সিল্কের কাপড় দিয়ে তৈরি হয় অক্ষিগোলকের শিরা। আলাদাভাবে চুল প্রতিস্থাপনেই সময় লাগে অন্তত পাঁচ সপ্তাহ। যথাযথ মাপের জন্য প্রায় ১৮০টি ছবি ও আড়াইশ বার মাপ নিতে হয় একেকটি মূর্তি তৈরির পূর্বে। পরিচর্যার জন্য চুল ধোয়ানো এবং মেকআপ করানো হয় প্রত্যহ। এভাবে প্রতিটি মোমের মূর্তি তৈরিতে খরচ হয় প্রায় এক লাখ পঁচিশ হাজার ডলারের কাছাকাছি।

২০০৮ সালে বার্লিন শাখায় ৪১ বছর বয়সী একজন জার্মান ব্যক্তি অ্যাডলফ হিটলারের ভাস্কর্যটি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ধারণা করা হয়, জার্মানির স্বৈরশাসক অ্যাডলফ হিটলারের প্রতি অসন্তোষের ফলশ্রুতিতেই এই ঘটনাটি ঘটে। পরবর্তীতে মূর্তিটি মেরামত করা হয় এবং নিরাপত্তা আরো জোরদার করা হয় প্রতিটি জাদুঘরে।

শুধুমাত্র মোম দিয়ে তৈরি জাদুঘরটিতে একদিকে যেমন সযত্নে সংরক্ষিত রয়েছে ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত ব্যক্তিবর্গ, রাজকীয় ব্যক্তিত্ব, চলচ্চিত্র তারকা, খেলোয়াড়, স্বনামধন্য গায়ক-গায়িকা, রাজনৈতিক নেতাদের ভাস্কর্য, তেমনি অন্যদিকে রয়েছে খ্যাতনামা খুনী ব্যক্তিদের মূর্তিও। অভূতপূর্ব এই শিল্পে গড়ে ওঠা মাদাম তুসো জাদুঘর দেশটির পর্যটন শিল্পে ও অর্থনৈতিক দিকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে।

এই লেখা নিয়ে আপনার অনুভূতি কী?

Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!