World News Bengali 'মার্কিন প্রযুক্তি যেভাবে চীনের হাতে যাচ্ছে'

in news •  6 years ago 

worldnewbengali.png

গত গ্রীষ্মের ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্রের ডেলাওয়্যারের দেউলিয়াবিষয়ক আদালতে হুট করেই হাজির হলো অ্যাটপ টেক। ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক একটি তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি। চিপের নকশা তৈরি করে অ্যাটপ টেক। এই প্রতিষ্ঠান এমন একধরনের মাইক্রোচিপ তৈরি করতে পারে, যা দিয়ে স্মার্টফোন থেকে উচ্চ কার্যক্ষমতার অস্ত্রব্যবস্থা—সবই চালানো যাবে। অথচ সেই প্রতিষ্ঠান কিনা নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছে!

অ্যাটপ টেক নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণার পরই শুরু হলো আসল নাটক। আদালতে এটি কিনতে হাজির হয়ে গেল স্বল্পপরিচিত প্রতিষ্ঠান অ্যাভাটার ইন্টিগ্রেটেড সিস্টেমস। প্রতিষ্ঠানের নাম শোনা না গেলেও তাদের আছে ট্যাঁকভর্তি ডলার। আর তাই অ্যাটপ টেকে বিনিয়োগে অ্যাভাটার ইন্টিগ্রেটেড সিস্টেমসের প্রস্তাবে সায় না দেওয়ার কোনো কারণ পাননি আদালত। এখন এই বিনিয়োগের প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার কাজ চলছে।

চিপ তৈরি ও নকশার কাজগুলো পড়ে সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের আওতায়। মজার ব্যাপার হলো, অ্যাটপ টেক যখন নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে, তখন প্রতিষ্ঠানটির কর্মী ছিল ৮৬ জন। ওই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের বাজারে এই প্রতিষ্ঠানের অংশীদারত্ব ছিল ১০০ কোটি ডলারেরও বেশি। অথচ অ্যাটপ টেক নাকি দেউলিয়া! আর যে স্বল্পপরিচিত প্রতিষ্ঠানটি অ্যাটপ টেকে বিনিয়োগে আগ্রহী, সেটি গঠিত হয়েছে গত বছরের মার্চে। পাওয়া যাচ্ছে না তাদের মালিকের পূর্ণ পরিচয়। অ্যাভাটার ইন্টিগ্রেটেড সিস্টেমসের প্রধান পরিচালক হংকংভিত্তিক একজন ব্যবসায়ী। সুতরাং এই প্রতিষ্ঠানটি যে চীনঘেঁষা, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

ঠিক এভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি চীনের হাতে চলে যাচ্ছে। অনেক দিন ধরেই মার্কিন তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোতে চীন বিনিয়োগ করে যাচ্ছে। প্রথমে তাতে শুধু ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য আছে বলে মনে হলেও এখন কিন্তু আর তা মনে হচ্ছে না। পলিটিকোর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঠিক ওপরের ঘটনার মতো করে মার্কিন মুলুকের বিভিন্ন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগকারী হিসেবে ঢুকছেন চীনের ধনকুবেররা। এরপর ওই সব প্রতিষ্ঠানের নীতিনির্ধারণী পদে বসছেন চীনারা। নিজের প্রতিষ্ঠানে তৈরি পণ্যে স্বাভাবিকভাবেই মালিকের পূর্ণ অধিকার থাকে। এভাবে উদীয়মান মার্কিন প্রযুক্তিতে পড়ছে চীনের সিল।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, নতুন এই প্রক্রিয়ায় চীন সম্পূর্ণ আইনসম্মতভাবে মার্কিন প্রযুক্তি পকেটে পুরছে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সমস্ত নিয়মকানুন মেনে চলছেন চীনা ধনকুবেররা। ধারণা করা হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে সি চিন পিংয়ের সরকারও মদদ দিচ্ছে। অর্থাৎ পুরো বৈধ উপায়ে মার্কিন প্রযুক্তি ছিনিয়ে নিচ্ছে চীন, তা ডোনাল্ড ট্রাম্প যতই বিধি-নিষেধ আরোপ করার চেষ্টা করুন না কেন! বর্তমান আইনে চীনকে ঠেকাতে না পেরে এখন নতুন আইন বাস্তবায়নের চেষ্টা করছেন মার্কিন সরকার ও দেশটির আইনপ্রণেতারা।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নতুন প্রযুক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে ফেলছে চীন। কিছু প্রযুক্তির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায়োগিক ব্যবহারের আগেই তা নিয়ে চীন কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে। আবার কিছু তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মার্কিন সরকারের সঙ্গে তথ্য, প্রযুক্তি ও সামরিক খাতের উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করছে। পাশাপাশি এসব প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগকারী হিসেবে আছে চীনারা। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক গোপন তথ্য চলে যাচ্ছে চীন সরকারের হাতে। এতে করে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্ন হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে, নিত্যনতুন প্রযুক্তির মালিক হওয়া মানেই বিশ্ব অর্থনীতির নেতৃত্ব পাওয়া। সেই প্রতিযোগিতাতেও চীনের থেকে পিছিয়ে পড়ছে যুক্তরাষ্ট্র।

চীন যা করছে
২০১৫ সালে চীন ‘মেড ইন চায়না ২০২৫’ নামের কৌশলপত্রের ঘোষণা দেয়। মূলত, নিজেদের শিল্পায়ন প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতেই সি চিন পিং সরকার এমন সিদ্ধান্ত নেয়। যেকোনো মূল্যে এই কৌশল বাস্তবায়ন করতে চায় চীন।

দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, চীন চাইছে নতুন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলোকে করায়ত্ত করতে। এ জন্য বিদ্যমান আইনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ একটি পন্থা বের করেছে তারা। ‘মেড ইন আমেরিকা’—এই স্লোগানের বিপরীতে তৈরি হয়েছে ‘মেড ইন চায়না ২০২৫’। কলকারখানার প্রযুক্তিগত উন্নতি করা এর অন্যতম লক্ষ্য। এ জন্য চীনা বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে কাজ করছে দেশটির সরকার। স্রেফ বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রযুক্তি হস্তগত করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিনিয়োগের ওপর বেশি নজর দিচ্ছে চীন।

অর্থনৈতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিবি রিসার্চ এক প্রতিবেদনে বলেছে, ২০১৪ সালের হিসাবে দেখা গেছে, মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে চীনের মোট বিনিয়োগ ছিল ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি। অথচ ‘মেড ইন চায়না ২০২৫’ নামের কৌশল রাষ্ট্রীয়ভাবে গ্রহণের পর থেকে সেই বিনিয়োগের পরিমাণ হুট করেই আকাশ ছুঁয়েছে। ২০১৫ সালে এই বিনিয়োগের মোট পরিমাণ ছিল ৯ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। ২০১৭ সালে এই বিনিয়োগের পরিমাণ ১২ শতাংশ কমেছে। ওই বছর আমেরিকার বিভিন্ন স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মোট ১৬৫টি চুক্তি করে চীনের অর্থে চলা প্রতিষ্ঠানগুলো।

পলিটিকোর বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে নিত্যনতুন ও চমক জাগানিয়া প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো। এসব প্রতিষ্ঠানেই বিনিয়োগের সংকট বেশি থাকে। ঠিক সেই সুযোগটিই নিচ্ছে চীন। তবে যেসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিনিয়োগ করা হচ্ছে, তাদের সঙ্গে চীনের সংশ্লিষ্টতা পুরোপুরি প্রমাণ করা বেশ কঠিন।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, বর্ধিঞ্চু সম্পদের ব্যবহার নিয়েই চলতি শতকের শুরু থেকেই ভাবছিল চীন। নিজের দেশেও বিদেশি বিনিয়োগের দরজা খুলে দিয়েছে সি চিন পিংয়ের সরকার। দেশটি এখন নিজেদের পুরো শিল্পায়ন প্রক্রিয়া স্বয়ংক্রিয় করতে চাইছে। এ জন্যই অন্যান্য দেশের উদ্ভাবিত প্রযুক্তির প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। অর্থাৎ ভিন দেশের প্রযুক্তি বাজারে বিনিয়োগের মাধ্যমে শিল্পায়নে উন্নতি আনতে চাচ্ছে চীন। এর ফলে অর্থনৈতিকভাবেও এগিয়ে যাবে দেশটি। আর প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের বিষয়টি তো রয়েছেই। এ ক্ষেত্রে চীনের প্রধান আগ্রহ রোবোটিকস, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মহাশূন্যে ভ্রমণবিষয়ক প্রযুক্তি খাত।

যুক্তরাষ্ট্র উপায় খুঁজছে
মার্কিন প্রযুক্তি বাজারে চীনা প্রভাব কাটানোর উপায় খুঁজছে যুক্তরাষ্ট্র। ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্প্রতি চীনের বিরুদ্ধে যে বাণিজ্য যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, তা মূলত এই কারণেই। এই বাণিজ্য যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য হলো আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব নিয়ে চীনের সঙ্গে দর-কষাকষির সুযোগ তৈরি করা।

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশি বিনিয়োগের বিষয়টি দেখভালের জন্য একটি জাতীয় কমিটি আছে। এটিই মূলত মার্কিন প্রযুক্তিকে অন্য দেশের হাতে যাওয়া ঠেকাতে কাজ করে। এর নাম কমিটি অন ফরেন ইনভেস্টমেন্ট ইন দ্য ইউনাইটেড স্টেটস (সিএফআইইউএস)। ১৯৭০-এর দশকে এই কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু আজ পর্যন্ত এর প্রয়োজনীয় জনবল ও এখতিয়ার নেই। এ কারণে সাধারণত ছোট ছোট প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে নাক গলানোর সুযোগ পায় না সিএফআইইউএস।

পলিটিকোর বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ এখন সিএফআইইউএসের এখতিয়ার বাড়াতে নতুন বিল আনছে। যেভাবেই হোক মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে চীনের বিনিয়োগের লাগাম টেনে ধরতে চায় মার্কিন সরকার। দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়া হলে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে। তবে নিন্দুকেরা বলছেন, শুধু নতুন বিল আনলে হবে না, সিএফআইইউএসের বাজেট ও কর্মীসংখ্যাও বাড়াতে হবে।

চীনকে ঠেকাতে পারবে যুক্তরাষ্ট্র?
চীনা বিনিয়োগ নিরীক্ষা করার যে প্রক্রিয়া চালু করতে চাইছে মার্কিন সরকার, তাতে মূল বাধা হলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি বাজারের বর্তমান ব্যবস্থা। সিলিকন ভ্যালিতে চীনের বিনিয়োগকে কোনোভাবেই হুমকি হিসেবে দেখতে রাজি নন উদ্যোক্তারা। কারণ, যখন স্থানীয় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এসব ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছিল, তখন ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল চীন।

পলিটিকোর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিলিকন ভ্যালিতে চীনের বিনিয়োগ নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নিলে দেশের ভেতরেই বাধার সম্মুখীন হতে হবে ট্রাম্প প্রশাসনকে। কারণ, চীনের বিনিয়োগের ওপর সিলিকন ভ্যালির উদ্যোক্তারা প্রায় অন্ধভাবে আস্থা রাখেন। ধারণা করা হচ্ছে, চীনা বিনিয়োগে ছেদ পড়লে যুক্তরাষ্ট্রের নিত্যনতুন ও উদ্ভাবনী প্রযুক্তির গবেষণাও বাধাগ্রস্ত হবে।

তবে বিশ্বে দাদাগিরি করতে হলে চীনকে ঠেকানো ছাড়া উপায় নেই যুক্তরাষ্ট্রের। এ বিষয়ে সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের হুইপ জন করনিন গত জানুয়ারিতে যে মন্তব্য করেছিলেন, তাতেই পরিষ্কার হয়ে যায় ট্রাম্প প্রশাসনের মরিয়া হওয়ার কারণ। তিনি বলেছেন, ‘শুধু ভাবুন, চীনের সামরিক বাহিনী আরও শক্তিশালী, চৌকস ও মারণঘাতী হয়ে গেছে। এখনই যদি পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে ভবিষ্যৎ এমনই হতে চলেছে।’

Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!