মোঃ আল মামুন খানঃ ঢাকার ধামরাইয়ে শুরু হয়েছে ঐতিহ্যবাহী শ্রী শ্রী যশোমাধবের রথযাত্রা উৎসব। ১৪ জুলাই (শনিবার) বিকাল চারটায় রথটানার মাধ্যমে এই উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়।
উল্লেখ্য, প্রতিবছর রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় চন্দ্র আষাঢ়ের শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয় তিথীতে। এই রথযাত্রা একেক অঞ্চলে একেক নামে পরিচিত। ঢাকার উপকণ্ঠে ধামরাইয়ের রথযাত্রা শ্রী শ্রী যশোমাধবের রথযাত্রা নামে উপমহাদেশে বিখ্যাত।
এবারে ধামরাইয়ের রথযাত্রা উদ্বোধন করেন ঢাকা-২০ এর এমপি আলহাজ্জ্ব এম.এ মালেক। তিনি এই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন, ঢাকা জেলা প্রশাসক আবু সালেহ মো: ফেরদৌস খান, পুলিশ সুপার শাহ মিজান শাফিউর রহমান, ধামরাই উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ্ব তমিজ উদ্দিন, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি মিলন কান্তি দত্ত, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল কালাম, পৌর মেয়র গোলাম কবির মোল্লা, ধামরাই থানার ওসি রিজাউল হক দিপু প্রমুখ।
উদ্বোধন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেছেন মেজর জেনারেল (অব:) জীবন কানাই দাস। উল্লেখ্য, রথযাত্রা চলাকালীন ২০দিন ব্যাপী মেলা বসবে।
প্রসংগত, ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যের মহেশ্বের রথের মত শ্রী শ্রী যশোমাধবের রথমেলা বিখ্যাত। শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেবের রথযাত্রার প্রচলন পরীর জগন্নাথ দেবের মন্দির থেকে। ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে রথযাত্রার ব্যাপক প্রচলন রয়েছে। বাংলাদেশেও রথযাত্রা হিন্দুদের একটি পবিত্র উৎসব। সাড়ে ৩শ’ বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ধামরাইয়ের রথযাত্রা উৎসব ও মেলা। ধামরাইয়ের রথযাত্রা ও মেলার ইতিহাস প্রাচীন।
এখানে রয়েছে মাধবমূর্তি। ধামরাইয়ে মাধবমূর্তিকে কেন্দ্র করে চলে আসছে ঐতিহ্যবাহী রথযাত্রা ও মেলা। বাংলা ১০৭৯ সালে থেকে এ অঞ্চলে রথযাত্রা ও মেলা উৎসব পালিত হয়ে আসছে। বাংলার পাল বংশের শেষ রাজা যশোপাল এ মাধবমূর্তি উদ্ধার করেন। যশোপাল একজন প্রজা বৎসল ও ধার্মিক রাজা ছিলেন। তিনি এ অঞ্চলে প্রজাসাধারনের জন্য উৎসবের সূচনা করেন।
১৪ জুলাই (শনিবার) বিকেল ৪ টায় মাধব মন্দির থেকে মাধব বিগ্রহসহ অন্য বিগ্রহ গুলো নিয়ে এসে সারা বছর যেখানে রথটি থাকে সেই রথখোলায় রথের ওপর মূর্তিগুলো স্থাপন করা হয়। এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রদীপ জ্বালিয়ে ও শান্তির প্রতীক পায়রা উড়িয়ে প্রধান অতিথি রথযাত্রা উৎসবের উদ্বোধন করেন।
পরে তিনি পুরোহিত উত্তম গাঙ্গুলির হাতে প্রতীকী রশি প্রদান করেন। বিকেল সাড়ে পাচঁটায় এরপর ভক্তরা পাটের রশি ধরে টেনে শ্রী শ্রী যশোমাধবকে তার কথিত শ্বশুরালয় যাত্রাবাড়ী মন্দিরে নিয়ে যান। এ সময় হাজার হাজার নারী-পুরুষ চিনি-কলা ছিটিয়ে যশোমাধবের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এখানেই রথটি প্রতি বছরের মতো ৮দিন অবস্থান করবে। মাধব ও অন্য বিগ্রহগুলো রথ থেকে নামিয়ে ৮দিন পূজা করা হবে কথিত মাধবের শ্বশুরবাড়ি যাত্রাবাড়ি মন্দিরে।
ঐতিহাসিক মতে জনশ্রুতি আছে, রাজা যশোপাল একদিন হাতির পিঠে চড়ে বেড়াতে বের হন। রাস্তায় চলতে চলতে হাতি একটি মাটির টিবির সামনে এসে আর চলতে চায় না। রাজা অনেক চেষ্টার পর হাতিকে আর সামনে নিতেপারলেন না। রাজার নিদের্শে এলাকার লোকজন ওই মাটির ঢিবির খনন কাজ করে। পরে একটি মন্দির পাওয়া যায় এবং মন্দিরে শ্রী বিষ্ণুর ন্যায়শ্রী মাধব মূর্তি পাওয়া যায়।
পরবর্তীতে রাজার নামের সঙ্গে শ্রী মাধবের নাম যুক্ত হয়ে শ্রী যশোমাধব হয়েছে। রাজা ধামরাইয়ে জীবন রায় মৌলিককে মাধব মূর্তি প্রতিষ্ঠার করার জন্য অর্পন করেন। সেই থেকে ধামরাইয়ের শ্রী যশোমাধব অঙ্গনে পূজা অর্চনা চলে আসছে এবং এ যশোমাধব অঙ্গনকে কেন্দ্র করেই ধামরাইয়ের ঐতিহ্যবাহী রথযাত্রা ও রথ মেলা উৎসব পালিত হয়ে থাকে। হাজার হাজার হিন্দু ভক্ত রথযাত্রায় উপস্থিত হয়ে আজও শ্রী মাধবকে সন্মান জানায়।
রথযাত্রা উপলক্ষে পৌরসভা সদর এলাকা জুড়ে বসেছে মেলা। এ মেলায় রয়েছে নাগর দোলা, কুটির শিল্প, কাসাঁ-পিতল শিল্প, মৃৎশিল্প, ছোটদের খেলার সামগ্রী, শংকর ও মতিপালের প্রসিদ্ধ মিষ্টি সামগ্রী সমাহার এবং বিভিন্ন সামগ্রী দোকান বসেছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন স্থান থেকে দোকানীরা আসতে শুরু করছে।এছাড়া দুর দুরান্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক তাদের আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে রথযাত্রা দেখার জন্য আসতে শুরু করেছে।
মাধব মন্দির পরিচালনা পরিষদের অন্যতম সদস্য নন্দ গোপাল সেন জানিয়েছেন, বারের যশোমাধবের রথযাত্রার আয়োজন সংক্রান্ত সকল প্রস্তুতি সুন্দরভাবে সকলের উপস্থিতিতেই সম্পন্ন করা হয়েছে।
এ প্রসংগে ধামরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রিজাউল হক দিপু জানান, রথযাত্রায় নিরাপওা জোরদার করার জন্য আইন শৃংখলা বাহিনীর সর্বক্ষণিক নজরদারী রয়েছে। বিপুল সংখ্যক সাদা পোশাকে বিশেষ টিম, র্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা মোতায়েন করা হয়েছে। ধামরাই সদর রথযাত্রা ও মেলা অঙ্গন এক বিশেষ নিরাপওা বলয়ে আচ্ছাদিত থাকবে বলেও জানান তিনি।