"ঢামেকের ম'র্গ থেকে বলছি"
ঢাকা মেডিকেলের জরুরি ম"র্গে"র সামনে ভোর সাড়ে ৪ টা বাজের দৃশ্য এটি। বিড়ালটির সামনে পেছনে থাকা রুম দুটো তখন তাজা লা'শে ভর্তি। শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা লা'শ গুলো একের পর এক এ দুটো রুমে রাখা হয়। শেষ পর্যন্ত জায়গা ছিলো না আর। এটির সাক্ষী আমি নয়, সে রাতের এ বিড়ালটিও বড় সাক্ষী।
বলছি শুক্রবার (১৯ জুলাই) দিবাগত রাতের কথা। সারাদিন পল্টন এলাকায় পুলিশের সাথে আন্দোলনকারীদের ধা'ও'য়া পাল্টা ধা'ও'য়া, গো'লা-গু'লি, দেখতে দেখতে আর পুলিশের টিয়ারগ্যাস খেয়ে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাসায় ফিরছি...। বাসার কাছাকাছি আসতেই এক সহকর্মীর ফোন। ঢাকা মেডিকেলে একের পর এক সারি গু'লি'বিদ্ধ লোকজন আসছে।
একবার ভাবছি যাবো না, কিন্তু কোনভাবেই নিজেকে মানাতে পারলাম না। রিকশা ঘুরিয়ে ঢাকা মেডিকেলের পথ ধরলাম। ঢামেকে গিয়ে দেখি একের পর অ্যাম্বুলেন্স আসছে। অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর থেকে বের করা হচ্ছে গু'লি'বিদ্ধ, গুরুত্বর আহত লোকজন। এর মধ্যে অনেকে পথিমধ্যে মৃ'ত্যু'র কোলে ঢলে পড়েছেন, আবার অনেককে জরুরি অবজারভেশন রুমে রাখার কয়েক মিনিটের মধ্যে মৃ'ত্যু বরণ করছেন।
স্বজনদের শোরগোল আহাজারিতে ভারি ঢামেকের পরিবেশ। আমি হতবিহ্বল। জীবনে কখনো এমন ভ'য়া'ভহ পরিস্থিতি দেখিনি। কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ভাই হারানো এক ভাই সারি করে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাটলিয়ন আনসারদের সামনে বুক পেতে দিয়ে বলেন, গু'লি করুন। কেন দাঁড়িয়ে আছেন? গু'লি করে আমাদেরও শেষ করে দিন।
স্বজনদের এমন আহাজারি, আর প্রশ্নের জবাব কিংবা শান্তনা দেওয়ার ভাষা কারও জানা নেই। দাঁড়িয়ে থাকা সব ব্যাটলিয়ন আনসাররা বিমূর্ত হয়ে আছেন। কারও মুখে কোন কথা নেই। কয়েকজনকে নিবৃত্তে কাঁদতেও দেখেছি। সেদিন আমরা অনেকেই নিজেকে সামলে রাখতে পারিনি। অশ্রুতে ভিজেছিলো দু-চোখ।
যাইহোক, একের পর এক ম'র্গে বাড়ছে লাশের সারি! ম'র্গে আসা লা"শ গুলোর ছবি তুলে তালিকা করছি আমি সহ আরও দুজন গণমাধ্যমকর্মি। এর মধ্যে একজন যমুনা'র... ভাই, অপর জন এএফপি'র.... ভাই। এএফপির.... ভাই আমাকে বললেন, পুরো রাত থাকবেন? আমি বললাম, দেখি ভাই। তিনি বললেন থাকেন নোমান। সাংবাদিকতার জীবনে আর এমন রাত কখনো না ও আসতে পারে। একটু পর ভাই চলে গেলেন। তবে ফোনে আমার কাছ থেকে সার্বিক তথ্য নিয়েছিলেন।
এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি লা"শ আসলো অজ্ঞাত, যাদের লা"শ রাস্তার পাশে পড়ে থাকতে দেখে হাসপাতালে পাঠিয়েন পথচারীরা। একদিকে র'ক্ত সংকট, রিদম ব্লাড ব্যাংক সাধারণ মানুষ থেকে র'ক্ত নিয়ে সেটি পূরণ করার চেষ্টা করছে..।
রাত যত বাড়ছে, লাশের সারিও বাড়ছে। পল্টন এলাকা থেকে এক রিকশা চালককে আনা হয়, তার ৩ মেয়ে ১ ছেলে। ছেলেটি ছোট। মেয়েরা ঢামেকে এসে গড়াগড়ি দিচ্ছে, আর বলছে, আমার বাবা তো নিরীহ, তাকে কেন মা'র'লো? বলো আমার বাবা কি দোষ করেছে? আমার বাবা তো স"ন্ত্রা"সী না। কেন আমার বাবাকে গু"লি করলো। তাদের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার মত উত্তর কারও কাছে নেই। এই মৃ'ত্যু পুরী শহরের এ দৃশ্য পাষাণ হৃদয়ের মানুষের মনও গলে যাবে! কোন রকম নিজেকে সামলে নেই আবার।
একে একে দীর্ঘ হচ্ছে আমার খাতায় লা"শের সিরিয়াল। আমি জানি এ সঠিক তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হবে কিনা, তবে এ মানুষগুলো যাতে পরবর্তীতে কোন সহায়তার সুযোগ থাকলে সেটি পায়, সে জন্য বিশ্রামহীন এ রাতে লা-শের পেছনে পেছনে দৌড়ে তালিকা করা।
মাঝে মাঝে পা'দুটো যেন এক হয়ে আসছে, তবুও থামিনি। আমি যে থামতে আসিনি! এর মধ্যে মোহাম্মদপুর থেকে এক মা এলেন তার সন্তানের খোঁজে। তাকে পাচ্ছিলেন না। একমাত্র আদরের ধনের মৃ'ত্যু'র সংবাদ শুনে ঢামেকে এসে পাগলের মত খুঁজছেন। আমার কাছে থাকা লাশের তালিকা থেকে তাকে সন্ধান দিলাম, এবার যেন মুর্ছা যাওয়ার মত অবস্থা। একমাত্র সন্তান ইসমাইল জুতার ফ্যক্টরিতে কাজ করতো, মা নিজেই জানেন না, তার সন্তান কিভাবে নি'হ'ত হলো। শুধু শোনেছেন রাস্তায় পুলিশের গু'লি খেয়েছে।
এর মধ্যে বাহিরে এসে মাঝে মাঝে শ্বাস নেই। ভেতরে র'ক্তে'র গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসার মত পরিস্থিতি।
রাত আড়াইটার দিকে ম'র্গে'র সামনে গিয়ে দেখি চাদর দিয়ে ঢাকা দুটি লা'শ পড়ে আছে৷ আমি হাত দিয়ে চাঁদর উল্টিয়ে প্রথমে মুখের ছবি তুলি, পরে আরেকটু সরিয়ে বুকের ওপরে থাকা নাম ও সিরিয়াল নাম্বারের ছবি তুলি, নাম কবির হোসেন (৪০)। নাম ধরে ডাক দিতেই পরিবারের লোকজন এসে জানায়, শনির আঁখড়া থেকে এসেছেন। ছোট ছেলে মাশরিফ ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ায় বাবা তাকে আনতে যায়, পথিমধ্যে নির্দিষ্ট একটি দলের লোকজন প্রথমে তার মাথায় কো'প দেয়, পরে গু'লি করে।
এভাবে লা"শে"র মি'ছি'ল দেখতে দেখতে নেমে আসে ভোর। ফজরের আযান শেষে আমি বাসার পথে রওনা দেই...। আজ আকাশ যেন এক অন্য রকম। নীল আকাশে ছোপ ছোপ সাদা মেঘ, কোথাও কোথাও কালো মেঘে ঢেকে আছে। আজ সারা রাত এ শহরের আকাশে হেলিকপ্টার উড়েছে। আহ'ত-নি'হ'তদের স্বজনরা বলেছেন এ পরিষ্কার আকাশ থেকে নাকি গু'লি করে তাদের স্বজনজদের বুক ঝা'ঝরা করে দেয়া হয়েছে।
আমি নিস্তব্ধ শহরের শীতল বাতাস থেকেও যেন র"ক্তে"র গন্ধ পাচ্ছিলাম। বেশ কয়েকবার ম'র্গে প্রবেশ করায় হয়তে আমার কাছে এমন মনে হচ্ছে। এসব ভাবতে ভাবতে বাসার পৌঁছায়।
বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিই। বেশি সময়ের সুযোগ নেই। কারণ আমাকে আবার ১০ টার মধ্যে ঢামেকের পথ ধরতে হবে....।
(ঢামকের সেই বী'ভ'ৎস দিনগুলো...থেকে কিছু অংশ)
~আল-নোমান।
মালিবাগ, ঢাকা।
#Collected Post from a journalist