EnChroma নামক একটি অপটিক্যাল প্রতিষ্ঠানের রিপোর্ট অনুযায়ী পৃথিবীতে প্রতি ১২ জন পুরুষের একজন এবং প্রতি ২০০ নারীর ১ জন বর্ণান্ধতা কিংবা কালার-ব্লাইন্ডনেসের শিকার। আমরা অনেকেই জানি না আমরা কালার-ব্লাইন্ড কিনা! আবার অনেকে এটাও জানি না যে কালার-ব্লাইন্ড কি? আসুন আমরা আজকে একসাথে কালার-ব্লাইন্ড কি এবং কেন হয় তা জানার চেষ্টা করবো।
[নোটঃ লেখার এবং পড়ার সুবিধার্থে আমি বর্ণান্ধতার স্থানে কালার-ব্লাইন্ড শব্দটা লিখবো।]
কালার-ব্লাইন্ড বা বর্ণান্ধতা কি?
কালার-ব্লাইন্ড হলো কালার বা বর্ণের প্রতি অন্ধতা। পৃথিবীতে হরেক রকমের কালার রয়েছে। আমরা মনেকরি আমরা সকল রঙই প্রত্যক্ষ করি। কথা সত্য, যদি আমরা কালার-ব্লাইন্ড না হই। কিন্তু আমাদের প্রতি ১২ জনের মধ্যে যে ১ জন কালার-ব্লাইন্ড, তার পক্ষে সকল রঙ প্রত্যক্ষ করা সম্ভব নয়। যিনি সকল রঙ দেখে না কিংবা রঙের ভিন্নতা আলাদা করতে পারে না, তাকেই কালার ব্লাইন্ড বলে।
এখন একটা কনফিউশন আমাদের তৈরি হতে পারে যে, যিনি কালার-ব্লাইন্ড তিনি কি কোন রঙই আলাদা করতে পারেন না অন্য রঙ থেকে? উত্তরটা হবে, পারেন। আসলে কালার-ব্লাইন্ডের অনেক ক্যাটাগরি আছে। যেমন, ম্যাক্সিমাম কালার-ব্লাইন্ড মানুষ ''লাল - সবুজ কালার-ব্লাইন্ড'' হইয়ে থেকে। এদের অনেকেই লাল রঙকে আলাদা করতে পারে না। তারা কখনো লালকে সবুজাভ হলুদ দেখে, কখনো পুরো কালো রঙ হিসেবে অবলোকন করে। কখনো কখনো কালার-ব্লাইন্ডরা লাল রঙ চোখে দেখলেও এর গাঁড় এবং হালকা রঙের পার্থক্য বুঝতে পারে না।
অর্থাৎ, কালার-ব্লাইন্ড হলো একটি বিশেষ কালারের প্রতি অন্ধতা। মানে সেই রঙটাকেই কেবল আলাদা করতে না পারার প্রবণতা।
কালার-ব্লাইন্ড কত প্রকার?
মানুষ মূলত তিন রকমের কালার-ব্লাইন্ড হয়ে থাকে।
- লাল-সবুজ বর্ণান্ধ
- নীল-হলুদ বর্ণান্ধ
- সম্পূর্ণ বর্ণান্ধ
লাল-সবুজ কালার-ব্লাইন্ডনেসঃ
আমি আগেই বলেছি, লাল-সবুজ কালার-ব্লাইন্ডনেস হলো লাল রঙের প্রতি স্বাভাবিক প্রত্যক্ষতা প্রদর্শন না করা। এর ফলে মানুষ ঠিকমত লাল বর্ণ খেয়াল করে না। কখনো হালকা-গাড় এর মধ্যে পার্থক্য ধরতে পারে না, আবার কখনো লালকে কালো দেখে, আবার কখনো লালকে সবুজাভ হলুদ দেখে। কখনো কখনো এমনও হয় যে, সবুজ রঙ কে লালচে হলুদ দেখে।
নীল-হলুদ কালার-ব্লাইন্ডনেসঃ
এক্ষেত্রে এরা নীল রঙকে সবুজাভ দেখে। এদের জন্য লাল আর হলুদের মধ্য থেকে গোলাপি রঙ আলাদা করা কষ্টকর হয়ে যায়।
সম্পূর্ণ কালার-ব্লাইন্ডনেসঃ
একবার ভাবুন, আপনি সারাজীবনই আকাশের রঙ সাদা-কালো দেখবেন! কখনো আকাশের নীল দেখবেন না! প্রভাতে কিংবা গোধূলি লগ্নে দেখতে পারবেন না আকাশের রক্তিম আভা! আপনার কথা বাদ দেন, যারা সম্পূর্ণ কালার-ব্লাইন্ড তাদের কথাটা একবার ভাবুন! সাদা-কালো টিভির মত তাদের সবকিছুই সাদা-কালো। তবে প্রশান্তির বিষয় হচ্ছে এমন লোকের সংখ্যা খুবই কম। বলা যায় একটা জেনারেশনে একজন থাকে এমন। অর্থাৎ, প্রতি দশ বছরে পৃথিবীতে জন্ম নেয়া সকল শিশুর মধ্যে একজন টোটাল কালার-ব্লাইন্ড হয়ে জন্ম নেয়।
কেন মানুষ কালার-ব্লাইন্ড হয়?
কথায় আছে
বাপকা ব্যাটা, সিপাহীকি ঘোড়া।
কথাটা আপনি মানুন আর না মানুন, যে লোক কালার-ব্লাইন্ড তাকে এটাই মেনে চলতে হয়। কেননা অধিকাংশ কালার-ব্লাইন্ড রোগীর কালার-ব্লাইন্ড হওয়ার কারনটা জ্বিনগত। পুরুষের স্পাম কিংবা ক্রোমোজমের কারনেই বংশগত ভাবে মানুষ কালার-ব্লাইন্ড হয়ে থাকে। তবে মেয়েরা এক্ষেত্রে বেশ সুবিধাজঙ্ক স্থানে আছে। কারন, আমরা জানি
ছেলেদের দুইটি ক্রোমোজম হলো XY, অপরদিকে মেয়েদের দুটি ক্রোমোজম XX.
আপনি যদি গ্রেগর ইয়োহান মেন্ডেলের বংশবৃদ্ধির সূত্র পড়ে থাকেন কিংবা ক্রোমোজম এবং সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণে ক্রোমোজমের প্রভাব সম্পর্কে অবগত থাকেন (যদিও না থাকেন, সমস্যা নাই। আমি বলে দিচ্ছি),
সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারিত হয় বাবা-মায়ের ক্রোমোজম থেকে আসা ক্রোমোজম থেকে। মেয়েদের দুটি ক্রোমোজম XX এবং ছেলেদের দুটি ক্রোমোজম XY. এখন যদি বাবার X ক্রোমোজম জরায়ুতে আসে তবে, বাবার X এবং মায়ের X ক্রোমোজম মিলে XX ক্রোমোজম জোড় হয়। অর্থাৎ ওই সন্তান মেয়ে হবে। আবার যদি, বাবার Y ক্রোমোজম জরায়ুতে আসে তখন মায়ের থেকে প্রাপ্ত X ক্রোমোজম মিলে XY জোড় সৃষ্টি হয়। ফলে অই সন্তান ছেলে হবে। লক্ষণীয়, মায়ের ক্রোমোজম দুটিই XX. তাই সাধারণত সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণে বাবার ক্রোমোজম দায়ী।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, মেয়েরা সেইফ কেন? মেয়েরা সেইফ এই জন্য যে, যদি বাবা কালার-ব্লাইন্ড হয় এবং তার বাবার থেকে প্রাপ্ত X ক্রোমোজমে কালার-ব্লাইন্ডের জিনোম থেকেও থাকে, মায়ের থেকে প্রাপ্ত X ক্রোমোজম তা অনেকটাই রিকভার করতে পারে। কিন্তু ছেলেদের বেলায়, বাবার Y ক্রোমোজমের কোন ড্যামেজ মায়ের X ক্রোমোজম রিকভার করতে পারে না। তাই ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা বেশি সেইফ।
এছাড়াও শারিরিক কোন দূর্ঘটনা কিংবা ঔষধের প্রভাবে অনেক সময় নন-কালার-ব্লাইন্ড মানুষও কালার-ব্লাইন্ড হয়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রে চোখের রেটিনায় থাকা কালার নির্ধারক সেল/কোষগুলো ঠিকমত ইনফরমেশন ব্রেইণে পাঠাতে পারে না কিংবা ব্রেইণের যেই অংশ কালার ডিটেক্ট করে থাকে, তার অকার্যকরতাও কালার-ব্লাইন্ডের কারন হতে পারে। অনেক সময় মাথায় আঘাত পেলেও আমরা সাময়িক এমন সমস্যার সম্মুখীন হতে পারি। (এজন্য সবসময় বাইক চালানোর সময় হেলমেট ব্যবহার করুন।)
চিকিৎসা
কালার-ব্লাইন্ড রোগীদের জন্য নিশ্চিত কোন চিকিৎসা নেই, যেহেতু এটি ম্যাক্সিমামই জীনগত কারনে হয়ে থাকে। তবে লাল-সবুজ কালার-ব্লাইন্ড রোগীদের জন্য দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সামান্য পরিমাণ উন্নতি করা সম্ভবপর।
- আপনি কি কালার-ব্লাইন্ড তা পরীক্ষা করতে এই লিংকে যান।
*কালার-ব্লাইন্ডনেস সম্পর্কে আরো জানতে এই লিংকে যান।