আমাদের দেশের মাটি ও জলবায়ু বিভিন্ন সবজি চাষের জন্য খুবই উপযোগী। স্বল্প সময়ে ও স্বল্প যত্নে চাষ করা যায় বলে অর্থনৈতিক দিক, কর্মসংস্থান ও পুষ্টি বিবেচনায় শাকসবজি চাষের গুরুত্ব অপরিসীম। বর্তমানে বাংলাদেশে চাষকৃত প্রচলিত-অপ্রচলিত সবজির সংখ্যা প্রায় ৯০টি, যার মধ্যে ৩০-৩৫টি হলো প্রধান সবজি যা বাণিজ্যিকভাবে চাষোপযোগী। বাংলাদেশে মোট আবাদি জমির পরিমাণ ৮.৭ মিলিয়ন হেক্টর (সূত্র: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, কৃষি উইং, ২০১৬-২০১৭)। দেশের শতকরা ৯.৩৮ ভাগ জমি সবজি চাষের জন্য ব্যবহার হচ্ছে যার মাধ্যমে বর্তমানে মাথাপিছু ১২৫ গ্রাম সবজি সরবরাহ নিশ্চিত হচ্ছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (GAP) ডায়াটারি গাইডলাইন অনুসারে মানবদেহের পুষ্টি চাহিদাপূরণের জন্য একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের প্রতিদিন ১০০ গ্রাম পাতাজাতীয় সবজি, ২০০ গ্রাম অন্যান্য সবজি এবং ১০০ গ্রাম ফল খাওয়া উচিত। কোভিড-১৯ এর ভয়াবহ আক্রমণের ফলে সারা বিশ্বে ৫৩ লাখ ৩১ হাজারের ও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এবং আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ২৭ কোটি ১৯ লক্ষ মানুষ (সূত্র: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা: ১৯/১২/২০২১)। এই পরিস্থিতিতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণের পরামর্শ হলো, সুস্থ থাকতে প্রত্যেকের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। এ ছাড়াও মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তির অধিকতর বিকাশসহ শারীরিক সক্ষমতা অর্জনের জন্য খণিজ লবণ ও ভিটামিনসমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। উৎপাদন প্রতি বছর বাড়লেও নিয়মিত সবজি গ্রহণের হার সেরকম হারে বাড়ছে না। সেজন্য কৃষি মন্ত্রণালয় অধীনস্থ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরসহ অন্যান্য সকল সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জনগণের পুষ্টিস্তর উন্নয়নে বদ্ধপরিকর।
কৃষিবান্ধব সরকারের দিকনির্দেশনায় ও সহযোগিতায় কৃষি মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক মহোদয়ের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশে কৃষির ক্ষেত্রে এসেছে সাফল্য। কৃষি বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত দেশি ও বিদেশি বিভিন্ন রকম উচ্চমূল্য শাকসবজি, উন্নতমানসম্পন্ন, উচ্চফলনশীল ও হাইব্রিড জাতের সবজিকে সফলভাবে চাষ করার জন্য আধুনিক ও টেকসই চাষ পদ্ধতি এবং ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিচ্ছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাগণ। কৃষি কাজকে লাভজনক করার জন্য রপ্তানিযোগ্য উচ্চমূল্য ফসল চাষকে প্রাধান্য দেয়া ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি মেনে চলার পরামর্শ প্রদান করা হচ্ছে। বর্তমান কৃষিতে আরও যুক্ত হয়েছে বাণিজ্যিকীকরণ ও যান্ত্রিকীকরণের উদ্যোগ যা উন্মুক্ত করেছে উন্নয়ন ও সম্ভাবনার নতুন দুয়ার। এ লক্ষ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জাতীয় কৃষি নীতি-২০১৮, জাতীয় কৃষি সম্প্রসারণ নীতি-২০১৫ এসডিজি-২০৩০ অর্জনের লক্ষ্যে ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুসারে কাজ করে যাচ্ছে।
পরিবর্তিত জলবায়ুতে নিবিড় সবজি উৎপাদনে জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার, উচ্চমূল্যের ফসল চাষ, সর্জন পদ্ধতিতে সবজি চাষ, ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি চাষ, ছাদ কৃষি, মাশরুম চাষ প্রযুক্তি সম্প্রসারণ করছে। সবজি চাষকে জনপ্রিয়করণের লক্ষ্যে কৃষি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় ডিএই রাজস্ব, প্রণোদনা ও উন্নয়ন খাতের মাধ্যমে বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে এবং বাংলাদেশের উন্নয়নে কৃষির অবদান উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সবজি উৎপাদন বৃদ্ধি ও পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা মিটানোর জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে। যেমন: কন্দাল ফসল উন্নয়ন প্রকল্প, অনাবাদি পতিত জমি ও বসতবাড়ির আঙ্গিনায় পারিবারিক পুষ্টিবাগান স্থাপন প্রকল্প, ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা চাষ গবেষণা, সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয়করণ প্রকল্প, নিরাপদ উদ্যানতাত্ত্বিক ফসল উৎপাদন, সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা ও বাজারজাতকরণ প্রকল্প, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর-ইউনিসেফ পার্টনারশিপ অন নিউট্রিশন সেনসেটিভ এগ্রিকালচারাল সার্ভিস ডিএই-ইউনিসেফ পার্টনারশিপ এর মাধ্যমে পারিবারিক পুষ্টি অর্জনের জন্য কক্সবাজার এলাকার জনগণকে শাকসবজি চাষের প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ, আঙ্গিনা বাগান স্থাপন ও প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণ বিতরণ করে সবজি চাষ বৃদ্ধিতে ও খেতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে যাচ্ছে।
কৃষি পণ্যের ন্যায্যামূল্য নিশ্চিতে ও কৃষিকে লাভজনক করতে ডিএই এর সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে রপ্তানি বাড়ানোর উদ্যোগ ইতোমধ্যে গ্রহণ করা হয়েছে। নিরাপদ সবজি উৎপাদনে উত্তম কৃষি চর্চা (এঅচ) ২০২০ অনুসরণ করা হচ্ছে। সার, বীজসহ সব কৃষি উপকরণের মূল্যহ্রাস, কৃষকদের সহজ শর্তে ও স্বল্পসুদে ঋণ প্রদান, দশ টাকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগ, কৃষকদের নগদ সহায়তা, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ও ই-কৃষির সম্প্রসারণসহ গবেষণায় বিশেষ গুরুত্ব প্রদান দেয়া হচ্ছে। এই সকল কার্যক্রমের মাধ্যমে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জন হবে যা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-২০৩০ অর্জনে বিরাট ভূমিকা রাখবে। ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে কোভিড-১৯ নামক অতিমারির আঘাতের ফলে সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হলেও বাংলাদেশ বীরদর্পে এগিয়ে যাচ্ছে এবং খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। এরই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ জাতিসংঘ থেকে পুরস্কৃত হয়েছে । শাকসবজি উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশ তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে।
সুস্থ-সবলভাবে বেঁচে থাকতে নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্যের বিকল্প নেই। পুষ্টির চাহিদা পূরণে শাকসবজির অবদান অনন্য। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুসারে এক ইঞ্চি জমিও যাতে অনাবাদি না থাকে সে লক্ষ্যে ডিএই এর মাঠপর্যায়ে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রতি বছর চাষযোগ্য জমি কমে যাওয়া সত্ত্বেও উন্নত জাত ও আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় উৎপাদন বৃদ্ধি করা হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার উইংয়ের তথ্যানুসারে দেখা যাচ্ছে যে, ২০১৩-২০১৪ সালে প্রায় ৯.৬৮ লাখ হেক্টর জমিতে ১৯৩.৯৭ লাখ মে.টন আলুসহ সবজি উৎপাদন হলেও তা ২০২০-২০২১ অর্থবছরে বেড়ে ১৪.৩৩ লাখ হেক্টর জমিতে ৩১৬.৮৬ লাখ মে.টন উৎপাদিত হয়েছে। যা কৃষি সেক্টরের উন্নয়ন ও বর্তমান সরকারের সাফল্যের বহিঃপ্রকাশ মাত্র।
উদ্যানতাত্ত্বিক ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে হর্টিকালচার উইং এর তত্ত্বাবধানে হর্টিকালচার সেন্টারসমূহ জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি সমস্যা সমাধানে কৃষক ও উদ্যোক্তাদের চাহিদামাফিক সেবা প্রদান ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে গড়ে তুলছে। উচ্চমূল্য ফসলের উফশী এবং হাইব্রিড জাতের সবজির চারা উৎপাদন করে সরকারি মূল্যে সরবরাহ করছে। এই উইংয়ের আওতায় সারাদেশে মোট ৭৫টি হর্টিকালচার সেন্টার ও ১টি মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউট মাশরুম ও সবজির উৎপাদন বৃদ্ধিতে অসাধারণ ভূমিকা রাখছে। প্রতিদিনের আহারে সবজির ব্যবহারকে জনপ্রিয় করতে কৃষি মন্ত্রণালয় অধীনস্থ দপ্তর সংস্থা জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে যাচ্ছে। এ ছাড়াও খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর প্রতি বছর ৩ দিনব্যাপী জাতীয় সবজি মেলা আয়োজন করে থাকে। সবজির গুণাবলী, চাষের আধুনিক প্রযুক্তিসমূহ উপস্থাপন ও প্রচার, অপ্রচলিত ও অধিক ফলনশীল জাতের পরিচিতি এবং কৃষি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের ও উদ্যোক্তাদের অভিজ্ঞতা বিনিময় ও যোগাযোগের প্লাটফর্ম সৃষ্টি, ক্রেতা ও বিক্রেতার মিলনমেলা এবং নতুন প্রজন্মকে সবজি খাওয়ার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অনুধাবন করানোই এই মেলার মূল উদ্দেশ্য। বাংলাদেশের সবজির উৎপাদন বৃদ্ধিতে যারা উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন তাদেরকে পুরস্কৃত করার মাধ্যমে সকল কৃষক-কৃষানি কে অনুপ্রাণিত করা হয়। রাজধানীর বুকে কেআইবি চত্বরে জানুয়ারি মাসে এই মেলাটি হয়ে থাকে। আশা করা যাচ্ছে মহামারি কোভিড-১৯ এর প্রকোপ কমে গেলে ২০২২ সালে জাতীয় সবজি মেলার আয়োজন হতে পারে
সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ যে বিপ্লব সাধন করেছে তা বর্তমানে সর্বজন স্বীকৃত। তবুও সবজি গ্রহণের হার বাড়ানো ও কৃষকের মুখে হাসি ফুটানো এখনো পুরোপুরি সম্ভব হয়নি। তাই ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত, গ্রামীণ জণগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে ও জাতীয় অর্থনীতিতে কৃষির অবদান বৃদ্ধিতে সবজির সঠিক বাজার ব্যবস্থাপনা, সংরক্ষণ, অপচয় রোধ, প্রসেসিং করা ও রপ্তানি বাড়ানো একান্ত প্রয়োজন। বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ থেকে শাকসবজি রপ্তানি হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে আলু, হিমায়িত সবজি, করলা, মুখীকচু, কচু, কচুরলতি, মিষ্টিকুমড়া, শিম বিচি, পটোল, কাঁচামরিচ, লাউ, চাল কুমড়াসহ অনেক সবজি বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। এ ছাড়াও মাননীয় কৃষিমন্ত্রী মহোদয়ের বিশেষ উদ্যোগে কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজে স্থাপিত উদ্ভিদ সংগনিরোধ ল্যাবরেটরিকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ল্যাবরেটরিতে রূপান্তর শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। ঢাকার পূর্বাচলে এক্রিডেটেড ল্যাবরেটরি স্থাপনের প্রকল্প প্রস্তুত করা হচ্ছে। যা ভবিষ্যতে শাকসবজি বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে ভূমিকা রাখবে।
সর্বোপরি বলা যায়, উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে বর্তমান সরকারের নিরন্তর প্রচেষ্টায় কৃষি ও কৃষিনির্ভর জনগণের উন্নয়নে আমূল অবদান রাখছে ও ভবিষ্যতেও রাখবে। সে সাথে সুস্থসবল পুষ্টিসমৃদ্ধ মেধাবী জাতি গঠনে সবজির উৎপাদন বৃদ্ধি ও নিয়মিত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।