প্রতিদিন রাত্রে খাওয়া দাওয়ার পর আমি মোবাইলটা নিয়ে গল্প লিখতে বসি l ভৌতিক গল্প বেশি l লেখার মাঝে মাঝে টুং টাং শব্দে বুঝতে পারি , মেসেঞ্জারে নানারকম পোস্ট আসছে l বেশির ভাগ থাকে গুড নাইট গোছের l খানিকটা লেখার পর অভ্যেস মতো পোস্ট গুলো পড়ি l কিছু উত্তর দিই l আবার লেখা শুরু করি l
সেদিন বাইরে রিমঝিম করে বৃষ্টি নেমেছে l পীর বাবাকে নিয়ে একটা ভৌতিক গল্প লিখছি l আমি একটানা লিখতে পারি না l পর্ব হিসেবে লিখি l বন্ধুরা এর জন্যে খুব বিরক্ত হয় আমার ওপরে l আসল কথা আমি দেখতে চাই , গল্পটা তাদের ভালো লাগছে কি না ? ভালো লাগলে , পরের পর্বের জন্যে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে সেদিন তৃতীয় পর্বটা লিখছি l বেশ একটা গা ছমছম করা পরিবেশ সৃস্টি করেছি গল্পের মধ্যে l
এইসময় একটা টুং শব্দ করে মেসেজ এলো l মনটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়লো l ঘড়িতে সময় সাড়ে দশ l দেখি একবার ...কে আমাকে অন্যমনস্ক করলো ? বাইরে বৃষ্টির বেগ একটু বেড়েছে l ...দেখলাম নতুন অনুরোধ পাঠিয়েছে , জনৈকা চিত্রা দেবী নামে এক মহিলা l ছবির জায়গায় শূন্য l একদম ফাঁকা l প্রোফাইলে গিয়ে তেমন কিছু চোখে পড়লো না l তবে বেশ কিছু গ্রূপের সঙ্গে যুক্ত l ছবি না থাকলে , সাধারণত আমি একসেপ্ট করি না l
মেসেঞ্জারে লিখেছে -- আমি আপনার ভৌতিক গল্পের একনিষ্ঠ ফ্যান l একান্ত অনুরোধ , আমার অতি প্রয়োজনীয় কয়েকটা কথা আপনাকে বলতে চাই l ..
এটাও আমি জানি l কয়েকজন এর আগেও এই প্রয়োজনীয় কথা গুলো বলেছে l যেমন , ভূতে আপনি বিশ্বাস করেন কি না ? কখনও দেখেছেন ওঁদের ? ..পীরবাবা সত্যি আছে কি না ? এইসব প্রশ্ন l ...কিন্তু ভদ্রমহিলার শেষ কয়েকটা লাইন আমার মনে প্রশ্ন তুলে দিলো l সেটা হলো...যদি আমার কথাগুলো অবান্তর মনে হয় ? সঙ্গে সঙ্গেই আমাকে ব্লক করে দেবেন l আমি আপনার উত্তরের জন্যে লাইনে অপেক্ষারত l আর আমাকে ফেস বুকেও যুক্ত করতে হবে না l মেসেঞ্জার থেকেই বিদায় নেবো l
একটা সুপ্ত কৌতূহল জাগ্রত হল বুকের মাঝে l তেমন কিছু উল্টো পাল্টা কথাবার্তা বললে ...ব্লক করা আমার হাতে l একসেপ্ট করার সাথে সাথে দেওয়ালে বসা টিকটিকিটা ....ঠিক ঠিক করে ডেকে উঠলো ! জানলা দিয়ে এক ঝলক বিদ্যুতের আলো দেখা গেলো l আকাশটা গুড়গুড় করে ডাকলো ! ...এ কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে প্রকৃতি ?
পরক্ষনেই ভেসে এলো বাক্যের লিখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে l -- অনেক ধন্যবাদ বন্ধু l আমি লিখলাম ..যা বলার তাড়াতাড়ি বলুন l গল্পের শেষ অংশ লেখা এখনও বাকি আছে l
চিত্রা দেবীর কালো শূন্য ছবিটা লিখলো l -- আপনার লেখা ভৌতিক গল্পের আমি একজন নিয়মিত পাঠিকা l শুধু নিঃশব্দে আপনার লেখা পড়ে চলি l কোন লাইক কমেন্ট না দিয়ে l কিন্তু আজ যখন বৈদ্যুতিক চুল্লি গল্পটা পড়লাম l সিদ্ধান্ত নিলাম , আজকেই আপনার সঙ্গে কথা বলবো l অনেক লাইক কমেন্ট পেয়েছেন গল্পটায় l অনেকে প্রশ্ন করেছে ...গল্পটা সত্যি কি না ? রফিক সত্যি আছে কি না ? আমি সেই প্রশ্নের মাঝে যাবো না l আমার কয়েকদিন ধরে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে l কাউকে বলতে পারিনি ! শুনে কেউ যদি পাগল বা ভূতে ধরেছে বলে ? আপনি একটু সময় দেবেন আমাকে ? ওই ঘটনা বলার জন্যে ? একমাত্র মনে হলো , আপনাকেই বিশ্বাস করে বলা যায় l কেননা এই অলৌকিক ব্যাপারটা আপনি হয়তো বিশ্বাস করেন ?
ভদ্র মহিলা একটানা লিখে থামলো l আমার উত্তরের জন্যে l -- এর মধ্যে কৌতূহল আমার বেড়েছে l এই রকম আজ পর্যন্ত কেউ লেখেনি ! কি অনুভূতি ? আর যাই হোক শুনলে হয়তো ভৌতিক গল্পের একটা প্লট পেয়ে যেতে পারি ..l ঘড়িটা দেখলাম l পৌনে এগারোা বাজতে চলেছে ...l একটু বাদেই স্ত্রী , টিভি বন্ধ করে শুতে যাবার সময় আমায় ডাকবে l তার আগে গিয়ে ওকে একটু মিথ্যে বলে শুতে পাঠাই l
লিখলাম...আপনি বক্তব্য লিখুন l দেখছি l
মোবাইলটা রেখে ওপরে এলাম l " তুমি শুয়ে পড়ো l গল্পের শেষটুকু লিখে আসতে একটু দেরি হবে l "
" কেন ? বাকিটুকু কাল সকালে লিখলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে ? " রাগলাম না l তাহলেই সব কেঁচিয়ে যাবে l
" কাল সকালে সময় পাবো না l শম্ভুকে বলে রেখেছি , কাল বাজারে গিয়ে ওর কাছ থেকে ইলিশ আনবো l " গিন্নি ইলিশ খেতে খুব ভালোবাসে l
" ..বেশি রাত করবে না l রাত বিরেতে ঐসব ছাই পাঁশ গল্প না লেখাই ভালো l কোনদিন তোমাকে না কোন পেত্নী ধরে ! "
কথা শেষ করার জন্যে বললাম l " গুড নাইট " l স্ত্রী টিভি বন্ধ করতে উঠলো l আমিও নিচে নেমে এলাম l এতক্ষনে নিশ্চয়ই চিত্রা দেবী তার অনুভূতির কথা লিখে ফেলেছে l ফোনটা অন করলাম l দেখলাম টাইপিং চলছে l ...বাইরে একটা বৃষ্টি ঝরা রাতের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে ! এক অজানা বন্ধু , অজানা অনুভূতি লিখছে l টেবিল থেকে জল খেয়ে এসে বসলাম l এক মিনিটের মধ্যেই লেখা গুলো এসে গেলো l আগ্রহ নিয়ে পড়তে শুরু করলাম l
--- প্রথমেই বলি , আপনি ভূতের গল্প লেখেন কল্পনার সাহায্যে l আর আমি তাঁদের দেখি চোখের সামনে l এই দেখতে পাওয়া জিনিসটা শুরু হয়েছে , গত এক সপ্তাহ ধরে ..l মনে মনে হাসছেন নিশ্চয়ই ...ভাবছেন কি পাগলের পাল্লায় পড়লাম এই রাত্রি বেলায় ? এভাবে চললে ভয় ও আতঙ্কে আমি সত্যি খুব শিগগির.... হয় পাগল হবো ! নচেৎ হার্ট এট্যাক করে মারা যাবো l প্লিজ দাদা আমাকে বাঁচান l একটু ধৈর্য ধরে আমার সব কথা শুনে নাহয় আমাকে পাগল আখ্যা দেবেন l লিখতে একটু সময় লাগছে ..l ভয় নেই আপনার ফোন নম্বর চাইবো না l যদি অনুমতি করেন , তাহলে লিখবো l কিভাবে আমার জীবনে এই ঘটনা প্রথম ঘটলো l সব শুনে , যদি মনে হয় ...তাহলে কোন ভালো তান্ত্রিকের সন্ধান দেবেন আমায়.... l
ওর কথা শুনে মনে হচ্ছে , আমি নিজে যেন কোন ভৌতিক গল্প লেখার সূচনা করতে চলেছি l বুঝতে পারছি আজকে ঘুমোতে যেতে বেশ রাত হয়ে যাবে ! কিন্তু এইরকম কথা শুনে ...বাকিটা শোনার কৌতূহল চাপা রাখতে পারছি না l অতীন্দ্রিয় শক্তি যে কিছু আছে ...তা একেবারে হাওয়ায় উড়িয়ে দেওয়া যায় না l তাই লিখলাম l -- আপনি লিখুন আপনার অভিজ্ঞতা l আমি অন লাইনে আছি l
ওধারে টাইপিং শুরু হলো l আমি ভেবে চললাম l সত্যি উনি কোন মহিলাতো ? কেননা ফেক আই ডি হতে পারে ! প্রোফাইলে বিশেষ কিছু নেই l এই সময় মাথায় একটা কথা খেলে গেলো l ...উনি সত্যি আমাদের মতো রক্ত মাংসের মানুষ তো ?
এই কথাটা মনে হতেই সারা গায়ে একটা হালকা শিহরণ খেলে গেলো l এই বৃষ্টি বাদলে এমনিতেই একটা গা ছমছমে পরিবেশ l রাত এগারোটাতেই গভীর রাত্রি মনে হচ্ছে l স্ত্রী ওপরের ঘরে ঘুমোচ্ছে l আর আমি নিচে সোফায় একা বসে , কোন অচেনা অজানা ফেস বুক বন্ধুর ভৌতিক অভিজ্ঞতার কাহিনী শোনার জন্যে বসে আছি !! একবার ভাবলাম ফোন নম্বরটা দিয়ে দিই l পরক্ষনেই সেই ভাবনাটা ত্যাগ করলাম l
এসে গেলো...চিত্রা দেবীর লেখা l -- সাত দিন আগে এক বান্ধবীকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলাম l আমাদের এই অমরপুরে একমাত্র হাসপাতালটা যেমন নোংরা তেমনি বাজে l এখনও মান্ধাতার আমলে পড়ে আছে l যাইহোক , বান্ধবীকে দেখে ভাবছি ...কখন এই নরক থেকে বেরোবো l এই রকম অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে কোন রোগী সুস্থ হয় ? ওর বাড়ির লোকরাও চাইছে , এখান থেকে ওকে নিয়ে শহরের হাসপাতালে ভর্তি করাবে l ওকে দেখে বেরোতে যাচ্ছি , খুব বাথরুম পেলো l রিক্সা নিয়ে বাড়ি যেতে বেশ খানিকটা সময় লাগবে l বাধ্য হয়ে , হাসপাতালের বাথরুমে এলাম l সন্ধ্যের আলোতে বাথরুমটা যেন আরও অন্ধকার ! টিমটিমে একটা আলোতে অদ্ভুত এক পরিবেশের সৃষ্টি করে রেখেছে l তীব্র প্রস্রাবের ঝাঁঝে মাথা ঘুরে যাবে মনে হচ্ছে l
নাকে রুমাল দিয়ে বাথরুম সেরে বেরিয়ে আসতে যাচ্ছি , মনে হলো একগাদা মাকড়সার জাল চোখে মুখে লাগলো l আশ্চর্য ! ঢোকার মুখে দরজায় কিছু ছিল না আর এক মিনিটের মধ্যে এতো মাকড়সার জাল ? ...শঙ্করবাবু , এটাই ছিল প্রথম অনুভূতি l আমি অবিবাহিতা l বয়স ত্রিশ l বিয়ের দেখা শোনা চলছে l তাই কাউকে বলতে না পেরে আপনাকে বলছি l আমাদের এই শহরতলীর কেউ যদি শোনে বা জানতে পারে আমার অভিজ্ঞতা ? আমার বিয়ে ভাঙতে এক মিনিটও দেরি লাগবে না l একই কারণে বাড়ির লোককেও জানাই নি l
এরপরের ঘটনা শুনলে আঁতকে উঠবেন ! --- এইটুকু পড়ে আমার মনেও একটা বিশ্বাস দানা বাঁধতে শুরু হয়েছে l আমি অনেককে বলি পীর বাবার মাজার , গল্প কথা l আসলে আমি চাই না , নিজেকে ঝামেলায় জড়াতে ! সেইরকম বুঝলে এক্ষত্রে ওকে রফিকের ঠিকানাটা দিয়ে দেব l
লিখলাম -- আপনি বলুন , আমি শুনছি l ঘড়ির কাঁটা এগারোটার ঘর ছাড়াচ্ছে l বাইরে বৃষ্টি হয়েই চলেছে l দেখলাম ও টাইপ করছে l একটু সময় লাগবে l এই ফাঁকে একটা সিগারেট ধরালাম l চিন্তা করছি , কি অভিজ্ঞতা শোনাবে ? নিকোটিন পোড়া.... ধোঁয়ার কুন্ডলি জানলা গলে বাইরের অন্ধকারে মিশছে l © Sankar Chatterjee.
....এসে গেলো ...সেই অদেখা অচেনা বন্ধুর অভিজ্ঞতার বর্ণনা ...l --- আপনার থেকে বয়সে অনেক ছোট আমি l তুমি বলেই ডাকুন l কয়েকদিন আগে ভ্যাপসা গরমে রাত্রে ঘরে শুয়ে দু চোখের পাতা এক করতে পারছি না l দোতলার ঘরে আমি একাই শুই l পুরোনো বাড়ি আমাদের l চারপাশে কয়েকটা বড়ো বড়ো গাছ আছে l যেমন আম , কাঁঠাল , নিম প্রভৃতি l গাছপালা গুলো নীরব l একটা গুমসুনি ভাব l গতকাল বন্ধুকে হাসপাতালে দেখে আসার পর থেকেই কেমন যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছে শরীর জুড়ে l সব থেকে বাজে যেটা , সেটা হলো l কাল রাত থেকেই ভালো ঘুম হচ্ছে না l
আজ আবার এতো গরম l পাখার হাওয়া পর্যন্ত গরম l শুয়ে শুয়ে ভাবছি , ছাদে গেলে হয়তো একটু আরাম পেতাম ! খোলামেলাতে একটু ঠান্ডার ভাব থাকতে পারে l এই সময় ...বাইরের বারান্দায় লাগানো , দাদুর আমলের দেওয়াল ঘড়িটায় ....ঢং ....ঢং করে বারোটা ঘন্টা পড়লো l
পরক্ষনেই আমার শরীরে একটা ঠান্ডা বাতাস লাগলো l চেয়ে দেখি , কি আশ্চর্য ! আমি একা আলসেতে হেলান দিয়ে ওই অন্ধকার ছাদে দাঁড়িয়ে আছি l সে কি ! আমি কি ঘুমের ঘোরে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে এসেছি ? তাই বা কি করে সম্ভব ? এক মুহূর্তের জন্য বুঝতে পারবো না ? ঘড়ির ঘন্টার শব্দ পরিষ্কার কানে শুনলাম ! তখনও তো আমি খাটে শুয়ে ! আর এক মিনিটের মধ্যে ছাদে ?
কালো ভেলভেটের মতো অন্ধকার আকাশে তারা গুলো নিজের মহিমায় আলো বিকিরণ করে চলেছে l চারিদিক নিস্তব্ধ l বেশ ভয় করতে লাগলো l এই সময় , ছাদের কোনের পাঁচিলের দিকে চোখ পড়লো l সেখানেও কেউ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে l বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো ..l ভালো ভাবে তাকাতেই ...ভয়ের মাকড়সাটা মেরুদন্ড বেয়ে নিচের দিকে নেমে গেলো l কালো ছায়ার মতো লোকটা ...এবার আলসের ওপর উঠে বসলো l যে কোন মুহূর্তে নিচে পড়ে যেতে পারে ! আমাকে আরও আতঙ্কের মধ্যে ফেলে দিয়ে ওই মূর্তিটা ছাদের পাঁচিলের ওপর দাঁড়িয়ে উঠলো l
আমার শুকনো গলা দিয়ে একটা অস্ফুস্ট আর্তনাদ বেরিয়ে আসতেই l ওই কালো মূর্তিটা , একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা আম গাছটার ওপর লাফ দিল l বুকটা ভয়ে ঠান্ডা হয়ে গেলো l ...কালো অস্পষ্ট শরীরটা গাছের ডাল পাতার মধ্যে সেঁধিয়ে গেলো ! কিন্তু একটা পাতাও নড়লো না l কোন শব্দ শোনা গেলো না l এবার রীতিমতো ভয় লাগছে l তাড়াতাড়ি ছাদের দরজার দিকে এগিয়ে যেতে গিয়েই ! থমকে গেলাম...l হাত পা কাঁপতে লাগলো l ছাদের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ! মাথা কাজ করছে না ! আমি ছাদে এলাম কি করে ? দরজায় ধাক্কা দিতে গিয়ে থেমে গেলাম l নিচ থেকে বাবা , মা এসে যদি প্রশ্ন করে ? আমি বন্ধ দরজা ভেদ করে ছাদে এলাম কি করে ?
একটু ও থামতেই , নিজের অজান্তেই লিখলাম l
-- তারপর কি হলো ? ...আমার মতো ভৌতিক গল্পের লেখককেও চিত্রা তার গল্পের আকর্ষণে সন্মোহিত করে ফেলেছে !
....এরপরে যা জবাব এলো ! আমি কল্পনাতেও ভাবতে পারিনি !
এরপরে যা ঘটলো , অকল্পনীয় ! ...ছাদের আলসেটা আমায় চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে চললো l মন বলতে লাগলো...ওখান দিয়েই নিচে যাবার সিঁড়ি পেয়ে যাবি l ভেবে পাচ্ছি না , এই অবাস্তব চিন্তা আমার মাথায় আসছে কি করে ? গিয়েই একবার দেখি ! ...আশ্চর্য শঙ্কর বাবু , ছাদের আলসের কাছে গিয়ে উঁকি মারতে , দেখতে পেলাম ! একটা সাদা দড়ির সিঁড়ি দোতলার আমার জানলা পর্যন্ত ঝুলছে l এবং অতি সহজেই ওটা বেয়ে নিচে নেমে এসে , জানলা গলে ঘরে ঢুকে এলাম ! ..বুঝতেই পারছি ,আপনি এবার অবিশ্বাস করতে শুরু করেছেন ! আপনার কি দোষ ? ওই মাঝ রাতে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে , আমি নিজেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না !
অবশ্য শেষ কালে আপনি বিশ্বাস করতে বাধ্য হবেন l এটা জোর দিয়ে বলতে পারি ! আসছি এবার পরের ঘটনায় ...l ওই দিন থেকেই আমার জীবনে ঘুমের সময় পরিবর্তন হয়ে যায় l রাত বারোটা থেকে ভোর চারটে পর্যন্ত চোখে ঘুম থাকে না l অন্য সময়ে চোখের পাতা ভারী l এ ছাড়াও অনেক পরিবর্তন ঘটতে থাকে l যেমন , আলো সহ্য হয় না l ক্ষিদে শরীরে নেই ! সব কিছুতে অনীহা ! আয়না দেখলেই ভয় লাগে l সাজতে গুজতে একদম মন চায় না l মনে হয় , চুল এলো করে ঘুরে বেড়াই l
এ ছাড়া একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করছি l রাত বারোটা থেকে ভোর চারটে পর্যন্ত , কোথাও যেতে ইচ্ছে হলেই , পর মুহূর্তে সেই জায়গায় এক মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাচ্ছি ! যেমন , পরের দিন খবর পেলাম .l ..আমার সেই অসুস্থ বান্ধবী , সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে l রাত্রে শুয়ে তার কথা মনে করতেই দেখি , তার বেডের কাছে আমি দাঁড়িয়ে আছি l কিন্তু ও আমাকে দেখতে পাচ্ছে না l আমার কথাও শুনতে পাচ্ছে না l প্রথম দু দিন ভালোই লেগেছিলো l এখন কেমন যেন গা ছমছম করে l কারণ , ওই রাতের সময়ই আমার চারপাশে ধোঁয়ার মতো সারি সারি ছায়া মূর্তির আবির্ভাব ঘটে l একেক জনের চেহারা দেখলেই বুকটা শিরশির করে ওঠে l
লেখা বন্ধ হলো l ...যতটুকু জানলাম , তা শরীরে ভয় ধরাবার জন্যে যথেষ্ট l ওর লেখা থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে ...ওকে ভূতে ধরেছে l এবং সেটা ধরেছে হাসপাতালের বাথরুম থেকেই l নিছক গল্প এতদিন লিখে এসেছি l এই ভাবে বাস্তবের সম্মুখীন কোনদিন হবো ? ভাবিনি ! ওকে তান্ত্রিক রফিকের ঠিকানা দিতেই হবে l জানিনা ও কিভাবে রফিকের সঙ্গে যোগাযোগ করবে ? বাড়ির লোকেদের অগোচরে ?
বাইরে বৃষ্টি খানিকটা ধরেছে l ঘড়ির কাঁটা বারোর ঘর ছুঁতে চলেছে l চিত্রার কথা মতো আর দশ মিনিট বাদেই ওর অশরীরি শক্তি জাগ্রত হবে l এরপরেও কি ওর সঙ্গে লেখা চালানো ঠিক হবে ?
ওর লেখা ভেসে এলো l --- আপনি কি ঘুমিয়ে পড়লেন ? আমার কথা শুনে কি ভাবছেন বলুন ?এদিকে আমার বাড়ির লোক কিছু একটা সন্দেহ করছে l আমার হাবভাব , আচার আচরণ তাদের চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে ...l আগামীকাল ওরা আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে l আমি কিন্তু বেশ বুঝতে পারছি l ডাক্তারের দ্বারা এই রোগের চিকিৎসা সম্ভব নয় l
এক মিনিট চিন্তা করলাম l কি উত্তর দেব ? লিখলাম l --- তুমি যদি বলো , আমি ওই তান্ত্রিকের ঠিকানা তোমায় দিতে পারি ! © Sankar Chatterjee.
উত্তর এলো l --- আগে আপনি বলুন , এইকম অনুভূতি কেন আমার হচ্ছে ? এ আমার মনের ভুল ? নাকি অন্য কিছু শক্তি আমার দেহে প্রবেশ করছে রাত টুকুর জন্যে ?
বুঝে পারছি না মেয়েটাকে কি বলবো ? তোমায় ভূতে ধরেছে বলাটা কি ঠিক হবে ? ও আরও আতঙ্কের মধ্যে পড়ে যাবে l একটু ভেবে লিখলাম l
--- অনেক সময় ভুল কিছু জিনিস , আমাদের মন সত্যি বলে মনে করে l বিশেষ করে দুর্বল মনের অধিকারী হলে l আগে বড়ো বড়ো যোগী পুরুষরা ইচ্ছে করলেই , চোখের নিমেষে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে পারতো l তার জন্যে তাদের অনেক উচ্চ স্তরের সাধনায় সফল হতে হতো l এক্ষেত্রে , সাধনা ছাড়াই কি ভাবে সম্ভব হচ্ছে ? মাথায় ঢুকছে না l
মিনিট দুয়েক কাটলো l মনে হয় , আমার লেখা পড়ে কিছু ও ভাবছে l চিত্রা আবার লেখা শুরু করলো l কি লিখবে ও ? আগ্রহে অপেক্ষা করছি l চোখ থেকে ঘুম চলে গেছে l উত্তর এলো l
" ...আমি একটু সময় কাটাচ্ছিলাম l কারণ.... বারোটা বাজার অপেক্ষায় আছি l প্রমাণ দিতে গেলে আরও তিন মিনিট সময় দরকার l এই সময়ের মধ্যে বরং আপনার ঠিকানাটা লিখে দিন l তারপরেই আপনাকে আমার কথার প্রমাণ দেব l " ....কি বলতে চাইছে ও ? আমার বাড়িতে এসে ও প্রমাণ দেবে ? একটা শিহরণ লাগলো শরীরে l ঘড়িতে বারোটা বাজছে l ঠিকানাটা লিখেই দিলাম l
এরপরেই ঘটলো , সেই রোমহর্ষক ঘটনা l
ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় বারোটা l পাড়াটা নিস্তব্ধ হয়ে ঝিম মেরে পড়ে আছে l বৃষ্টি কমে গেলেও মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে l আমি সোফাতে বসে মোবাইলের দিকে চেয়ে বসে আছি l জানিনা , অচেনা বন্ধু সত্যি কোন প্রমাণ দিতে পারবে কি না ? ...যদি দেয় , আমি সেই পরিস্থিতিতে কি করবো ?
হঠাৎ ...এক ঝলক হিম শীতল বাতাস জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়লো ! আমার ইন্দ্রিয়গুলো সজাগ হয়ে উঠলো ... l মেসেঞ্জারটা সচল হলো l ওর লেখাগুলো ভয় চকিত চোখে পড়লাম l
" ...এইমাত্র জানলা দিয়ে আপনার ঘরে ঢুকে , সোফার সামনেই দাঁড়িয়ে আছি l " -- আমার দেহের রোমকূপগুলো খাড়া হয়ে গেছে l বিশ্বাস , অবিশ্বাসের দোলায় দুলছি l ভয়ে ভয়ে ঘরের চারদিকে তাকাচ্ছি ! কই কাউকে দেখতে পাচ্ছি না l ও কি এই মুহূর্তে মেসেঞ্জারে টাইপ করতে পারবে ? ভাবনার সঙ্গে সঙ্গেই লেখা এলো l
" ....এদিক ওদিক তাকিয়ে লাভ নেই l আমার সূক্ষ্ম শরীর আপনি দেখতে পাবেন না l আপনার সোফার সোজাসুজি দোতলা যাবার সিঁড়ির , প্রথম ধাপেই আমি বসে আছি l " এতো নিখুঁত বর্ণনা ? বানিয়ে বলা যায় ? অসম্ভব l সিঁড়ির ধাপটা শূন্য l ...ওখানেই ও বসে আছে ? ঠোঁটটা শুকনো লাগছে আমার l জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে টাইপ করলাম আমার কথা l আর একটু নিঃসন্দেহ হতে হবে l
" ...তুমি বলতে পারবে ... আমি যে পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি পরে আছি l তার রং কি ? আর আমি যে মোবাইলে টাইপ করছি ...সেটার রং আর কোন কোম্পানির ? " ও যদি এই উত্তরগুলো ঠিক ঠিক দিতে পারে ! তাহলে আমাকে নতুন করে সব কিছু ভাবতে হবে l মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে হবে l আত্মার উপস্থিতি ! সেই বিশ্বাসের মুহূর্তে আমার হৃদয় কতখানি সংযত থাকবে জানিনা ! কেননা এখনই আমার বুকের ধুকপুকুনি বেশ জোরেই হচ্ছে l যা নিঝুম রাত্রে আরও বেশি করে কানে পৌঁচছে ! জল তেষ্টা পাচ্ছে l কিন্তু উঠে টেবিলে গিয়ে জল খেতে গেলে , ওই সিঁড়িটার কাছ দিয়ে যেতে হবে ! যেখানে ওই অদৃশ্য আত্মা বসে আছে l
এখনও পর্যন্ত চিত্রা ওই আত্মাকে নিজের কথামতো পরিচালিত করছে l সেটা কতক্ষণ স্থায়ী হবে জানি না ! ওই বিদেহী আত্মা যখনই নিজের শক্তি অর্জন করে ফেলবে ! চিত্রা ওর হাতের পুতুল হয়ে যাবে l ওর মেসেজ এলো l
" ...এখনও পরীক্ষা ? বেশ , আপনি হালকা আকাশি রঙের হাফ হাতা পাঞ্জাবি আর সাদার ওপর খয়েরি স্ট্রাইপ দেওয়া তাঁতের লুঙ্গি পরে আছেন l আপনার মোবাইলের রং ...সোনালী l স্যামসুং কোম্পানির গ্যালাক্সি l " প্রতিটা কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি l প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলাম ! স্নায়ু গুলো বিদ্রোহ ঘোষণা করতে শুরু করে দিয়েছে l মস্তিষ্কের কোষে কোষে এক টুকরো বরফ যেন সমস্ত অনুভূতি গুলোকে অসাড় করে দিচ্ছে ! হ্যাঁ....আমি বেশ বুঝতে পারছি ! আমার মুখের রংও এতক্ষনে ছাইয়ের মতো ফ্যাকাশে আকার ধারণ করেছে l
হঠাৎ ....এক সময় পাঁচ আঙুলের শাসন ডিঙিয়ে মোবাইলটা পড়ে গেলো মেঝেতে l মেটালের ফোনটা মাটিতে পড়ে...ঝন ঝন শব্দে আমাকে আরও ভয় ধরিয়ে দিলো l সাধের ফোনটা বোধহয় গেলো l ওই শব্দে দোতলায় ঘুমিয়ে থাকা স্ত্রীর ঘুম ভাঙলো l ওপর থেকে ভেসে এলো গলা l
" এই রাত দুপুরে কি ভাঙ্গলে ? " ওর গলার আওয়াজে মনে একটু সাহস ফিরে এলো l " এ কি সাড়ে বারোটা বাজতে চললো , এখনও নিচে কি করছো ? শোবে কখন ? "
শুকনো গলায় জবাব দিলাম l " ফোনটা হাত থেকে পড়ে গেলো l যাচ্ছি l " ফোনটা তুলে দেখি বন্ধ হয়ে গেছে l চালু হচ্ছে না l কাল সার্ভিস সেন্টারে যেতে হবে l জানলা বন্ধ করে , আলোর সুইচটা নেভাতে গিয়ে মনে পড়লো l এই অন্ধকারে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে হবে l যেখানে এখনও হয়তো ওই আত্মাটা বসে আছে ! ভয়েতে লজ্জার মাথা খেয়ে বলে উঠলাম l
" একটু দাঁড়াও তো l অন্ধকারে উঠতে ভয় লাগছে l " স্ত্রী এসে দাঁড়ালো l
" ...আর ভূতের গল্প লিখে সবাইকে ভয় দেখিও না l নিজেই একটা ভীতুর ডিম l " কথাটা হজম করে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে এলাম l মাথায় এক রাশ চিন্তা l চিত্রা এখন কোথায় ? ওর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো l যতক্ষণ না ফোন ঠিক হয় l ওর ঠিকানাও পুরোপুরি জানা হয় নি l রফিকের ঠিকানা বা ফোন নম্বর দেব কি ভাবে ? এর মাঝে যদি ওই অশরীরি , চিত্রাকে পুরো গ্রাস করে ফেলে ? এ ছাড়া ...সারারাত যদি প্রেতাত্মা টা এই বাড়িতে ঘোরাঘুরি করে ? শুয়ে শুয়ে এপাশ ওপাশ করে চলেছি l কোন আলোর হদিশ খুঁজে পাচ্ছি না l
বৌয়ের গলা কানের কাছে বেজে উঠলো l " কি একটা চিন্তা করছো তুমি ? আমাকে বলা যাবে ? " ইচ্ছে থাকলেও ওকে এইসব বললে আতঙ্কে কেঁপে উঠবে !
" সিঁড়ি দিয়ে উঠতে তোমার হঠাৎ ভয় লাগলো কেন ? " ও পুরোনো কথার জের টানলো l
" ....ভূতের গল্প লিখছিলাম l তাই একটু গা ছমছম করে উঠলো l " আমার মুখে এখনও ভয়ের প্রলেপ l
" ...যারা তোমার ভৌতিক গল্প পড়ে , তাদেরও নিশ্চয়ই ভয় লাগে ! " মিষ্টি করে বললো l " এমন ভয় পেলে যে , অত দামি ফোনটা ভাঙ্গলে l " চুপ করে রইলাম l রাত বাড়ছে ...l তাই ওকে চুপ করাবার জন্যে বললাম l
" তুমি ঘুমিয়ে পড়ো l রাত হয়েছে l " ও উঠে বসলো l
গায়ে হাত দিয়ে বললো l " তুমিও মাথা ঠান্ডা করে ঘুমিয়ে পড়ো l তোমার বন্ধু চিত্রা আর আসবে না l " চমকে উঠলাম l ©sankar Chatterjee.
" ...ওই নাম তুমি জানলে কি করে ? " অবাক গলা l
" কিছুদিন আগেও জানতাম না l তোমার মেয়ে এই প্ল্যান করে ওই ফেস বুক খুলেছে l বাবাকে ভয় দেখাবে বলে.. l আমি বললুম , তোর বাবা মোটেই ভয় পাবে না l তখন তোমার জামাই বললো , দেখুন না পায় কি না ? "
" তার মানে তুমি , টাইপ করছিলে ওপরে বসে ? "
" আমি ওসব পারি নাকি ? তবে মাঝে মাঝে ফিসফিস করে তোমার মেয়েকে জানাচ্ছিলাম , তুমি এখন কি পোষাক পরে আছো ! ...তুমি যখন মোবাইল ফেলে দিলে ? তখন ওদের বারণ করলাম l আর বাড়াবাড়ি করিস না l কাল সকালে জামাই এসে ফোন নিয়ে গিয়ে ঠিক করে দেবে বলেছে l ,"
এক রাশ শান্তি চোখে মুখে নেমে এলো l বুঝলাম পরিবেশ আর পরিস্থিতি মানুষকে কত ভীত আর দুর্বল করে তোলে l ...চোখে এবার ঘুম নামছে l একটু বাদেই ঘুমের রাজ্যে প্রবেশ করলাম l
Posted using Partiko Android