লুকানো চিঠির রহস্য
( ত্রিপুরার বাংলা গোয়েন্দা গল্প )
রাজবংশী সিরিজের চতুর্থ গোয়েন্দা গল্প
- হরপ্রসাদ সরকার, ধলেশ্বর-১৩, আগরতলা
১০-১০-২০১৮ ইং
পুলিশের এক DSP, বর্তমানে সে তরুণ পুলিশ অফিসার; খুব সাহসী, জাবাজ, নিডর, বুদ্ধিমান, নিষ্ঠাবান। স্কুল জীবন থেকেই এই গুনগুলি তার মধ্যে ছিল, কিন্তু কাজে লাগেনি। দাদাগিরি আর মস্তানিতে সে ছিল এক নম্বর। কলেজের গণ্ডি পার হতে-হতে তো এলাকার একটা ছোটা গুণ্ডা হয়ে গেল সে। সাদা-সিধা ও গরিব রিক্সা-ড্রাইভার, দিনমজুরদের ঘারে চেপে বসে তাদের পকেটে থেকে সব কেড়ে নিত। এ হেন এক গুণ্ডা ছোকরার পুলিশের এমন ইমানদার DSP হওয়াও কিন্তু কথার-কথা নয়। তবে তার জীবনে সেই পরিবর্তনটি এসেছিল একটি বিশেষ ঘটনার দ্বারা।
ছেলেটির ডাক নাম মিঠুন। হ্যাঁ, বিখ্যাত চিত্র-অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তীর নামে-নামেই ছেলেটির ডাক নাম মিঠুন। নামটি তার মা'র দেওয়া। তবে একটি ভাল নামও আছে তার; কিশোর কুমার দত্ত। মহান গায়ক কিশোর কুমারের নামে-নামেই মিঠুনের বাবা, মুরারি মোহন দত্ত নিজের দ্বিতীয় ছেলের নাম রাখলেন কিশোর কুমার দত্ত। মিঠুনের বড় ভাইয়ের নাম কানুগোপাল দত্ত, পুলিশ ইনস্পেক্টর।
মুরারিবাবুর স্বপ্ন ছিল, নিজে কিশোর কুমারের মত গায়ক হবেন। কিন্তু বিধাতা দিলেন না কণ্ঠ আর ভাগ্য দিল না পথ। তাই গায়কের বদলে পুলিশ হয়ে গেলেন। বাড়িতে বংশ-পরস্পরায় পুলিশের ধারা ছিল। সেই ধারা মেনেই পুলিশে যোগ দিলেন। কিন্তু মনের গোপন কোনে গায়কের স্বপ্নটি ঠিক রয়ে গেল। তাই বিয়ের পর যখন প্রথম সন্তান লাভ হল তখন তিনি তার নাম রাখতে চাইলেন তানসেন দত্ত। কিন্তু বৌয়ের প্রবল চাপে সেই নাম পাল্টাতে হল। ছেলের নাম হল কানুগোপাল। এই কানুকেও গায়ক বানাবার খুব চেষ্টা করছিলেন মুরারিবাবু। কিন্তু কানু, বাবার স্বপ্নটাকেই ঠিক বুঝল না। গান ছেড়ে গান ধরল; হয়ে গেল পুলিশ অফিসার; পরিবারের প্রথা।
কিন্তু মুরারিবাবু হার মানলেন না। কানুগোপালের জন্মের প্রায় দশ বছর পরে যখন দ্বিতীয় সন্তান লাভ হল তখন তিনি এই শিশুর নাম রাখলেন কিশোর কুমার। বৌ আবারও খুব বাধা দিলেন, কিন্তু মুরারিবাবু বৌয়ের কোনও কথাই শুনলেন না। শিশুর নাম কিশোর কুমার রাখবেন তো রাখবেনই। তাই হল, শিশুর নাম হল কিশোর কুমার। তা দেখে বৌও জেদ ধরলেন, ছেলের ভাল নাম যদি হয় কিশোর কুমার, তবে ডাক নাম হওয়া চাই মিঠুন। ফলে তাই হল, ডাক নাম হল মিঠুন আর ভাল নাম কিশোর কুমার। মানুষ পরিচিতি লাভ করে তার কাজের দ্বারা, নামে খুব একটা কিছু যায় আসে না। ঠিক তেমনি, মুরারিবাবুর অসীম ইচ্ছা স্বত্বেও মুরারির ছেলে কিশোর কুমার, দ্বিতীয় কিশোর কুমার হল না; সঙ্গ-দোষে অসুর-কুমার হয়ে গেল।
মিঠুনের বাড়ি আগরতলার শালবাগানে। এই শালবাগান থেকে একটি রাস্তা চলে গেছে গান্ধীগ্রাম হয়ে বামুটিয়ার দিকে; আরেকটি রাস্তা চলে গেছে সিধাই মোহনপুরের দিকে। তখনও মিঠুন পুলিশের চাকরি পায়নি। সবে মাত্র MBB কলেজ থেকে বি.এ পাশ করেছে। কলেজ পাশের পরেই তার দৌরাত্ম্য খুব বেড়ে গেল। শালবাগানের টিলাগুলির নির্জন স্থানে সাঙ্গ-পাঙ্গ নিয়ে ওঁত পেতে বসে থাকত। সময়-অসময়ে, সকাল-সন্ধ্যায় গরীব গ্রামবাসীদের বাগে পেলেই তাদের টাকা-পয়সা জোর করে কেড়ে নিত। গরীব গ্রামবাসীদের পুলিশের ভয় দেখিয়ে খুব ধমকাত, "মিথ্যা কেস সাজিয়ে জেলে পুরে দেব। যা আছে সব বের করে দে। টু-টা কোনও শব্দ বের করবি না। তা না হলে এমন এক ভীমবুইরা মারব যে সারাজীবনের জন্য পঙ্গু থাকবি।" সহজ-সরল গ্রামবাসীরা এ কথা শুনে খুব ভয় পেয়ে যেত। টাকা যায় তো যাক, কে আর কোর্ট-কাছারির ঝামেলায় পড়তে চায়?
এই ছিনতাইবাজ গুণ্ডার খবরটি কিন্তু আর চাপা পড়ে রইল না; কোনও না-কোনও ভাবে পুলিশের কাছে চলেই গেল। পুলিশও তুরন্ত কাজে নেমে পড়ল আর নতুন অপরাধী গ্যাংটিকে ধরতে জাল বিছাতে আরম্ভ করল। কিন্তু তার আর দরকার হল না। এর আগেই একটি ঘটনা ঘটল, যে ঘটনাটি মিঠুনকেই পাল্টে দিল। পাড়ার এক মস্তান হয়ে গেল দেশমাতার এক জাবাজ সিপাহী, এক জাঁদরেল পুলিশ অফিসার।
সেদিন ভোর বেলায় গান্ধীগ্রাম বাজার থেকে বরিদ চরণ তার রিক্সা নিয়ে আগরতলা শহরের দিকে যাচ্ছিল। ভোর বেলার গ্রামের পথ, কোথাও কোনও লোকজন নেই। শালবাগানের নিকট একটি টিলার কাছে আসতেই বরিদের ঘাড়ে শনি চাপল। মিঠুন-ওস্তাদ তার দল-বল নিয়ে বরিদের রিক্সা আটক করল, "এই বরিদ্দা, যা আছে সব দে। শনি পূজার চাঁদা।"
"এত ভোর বেলায় শনি-পূজার চাঁদা! আজ তো বুধবার!" বরিদ খুব অবাক সুরে বলল।
"হই বরিদ্দা, এত বুঝে ত তোর কাম নাই। কথা বাড়াবি না, যা বলছি তা কর। যা আছে সব দে, শনি পূজার চাঁদা।" চোখ লাল করে কথাগুলি বলল মিঠুন-ওস্তাদ।
বরিদ আর কোনও দ্বি-উক্তি না করে শনি-ঠাকুরের নামে পকেট থেকে একটি এক-টাকার কয়েন বের করে নমস্কার করে মিঠুন-ওস্তাদের হাতে দিল। ওস্তাদের এত বড় হাতের তালুতে ঐ এক টাকার কয়েনটি মনে হচ্ছিল যেন এক সুবিশাল সোনার থালাতে একটি শুকনা বাতাসা। ধপ করে বিজলী এসে পড়ল মিঠুন-ওস্তাদর মাথায়, পিত্তি দাউ-দাউ করে জ্বলে উঠল তার, "এটা ছিনতাই না ভিক্ষা? আমরা কি ভিক্ষা করতে এসেছে? এত অবহেলা? আমাদের কী কিছু দাম নেই?"
চীৎকার করে উঠল মিঠুন-ওস্তাদ, "এই বরিদ্দা! শালা! আমরা কী ভিখারি? ভিক্ষা করতে এসেছি? তুই এটা কী দিলি রে, বাতাসা, আমরা কী বাতাসা খেতে এসেছি? কান বেরিয়ে এমন এক চটকনা মারব যে, চোখের মধ্যেই মাথা ঘুরেতে থাকবে। শালা বরিদ্দা, তুই পেয়েছিস কী? খেলা নাকি? আমাদের কী কোন দাম নেই? মারব নাকি একটা ভীমবুইরা! শালা, হারামজাদা, বরিদ্দা!"
কোনও কথা না বলে বরিদ্দা পকেট থেকে আরও একটি এক-টাকার কয়েন বের করে মিঠুন-ওস্তাদের হাতে দিল। "আবারও এক-টাকা!" রাগে ওস্তাদের ঠোট থর-থর করে কাঁপতে লাগল। তা দেখে ওস্তাদের বড় চেলা, বেলুর নাক দিয়ে ক্ষিপ্ত ষাঁড়ের মত ফুঁত-ফুঁত হাওয়া বের হতে লাগল। ওস্তাদের সামনে নিজের রাগটাকে আরও বেশী-বেশি করে দেখাতে, বেলু শক্ত একটা ঘুষি মারল বরিদের গালে। ঠিক এমন সময় দু'জন লোক একটি মোটর সাইকেলে এসে তাদের পাশে দাঁড়াল। সেই মোটর সাইকেলটির নম্বর D-13 । ওস্তাদ হাত তুলে সেই বাইকটিকেও আটক করাল, "আগে বরিদ্দাকে দেখি, তারপর তোদেরও দেখব রে ঘটু। সালার ভাই, বুঝবি আজ মজা।" ওদিকে বেলুর ঘুষি খেয়ে বরিদের খুব যন্ত্রণা হয়েছে বলে মনে হল না। উল্টো, বেলুর নাকের ডগা আপেল মত লাল হয়ে গেল নিজের কচি হাতের যন্ত্রণায়। মুখটা তেরা-বেঁকা হয়ে ভয়ানক দেখাতে লাগল। তবু সে সম্মানের খাতির ওস্তাদের সামনে কিছুই প্রকাশ করতে পারছে না। একটু আগে নাক দিয়ে ফুঁত-ফুঁত হাওয়া বের হচ্ছিল, এবার মুখ দিয়েও ফুঁস-ফুঁস হাওয়া বের হচ্ছে। নিজের বীরত্ব বজায় রাখতে সে বরিদ্দার শার্টের কলার ধরে, ঠোট উঁচিয়ে কিছু বলতে গিয়েই হঠাৎ এক বিকট চীৎকার করে গরুর বাছুরের মত লেজ তুলে সোজা কুচির দিকে এক দৌড় মারল, "ভেঙ্গে গেল রে! ভেঙ্গে গেল রে। হাতে গাঁথনি নড়ে গেল গো। মাগো! মাগো!" বেলু চীৎকার করতে-করতে কোথায় ছুটে গেল, মা'র কাছে, ডাক্তারের কাছে না হাসপাতালে; কিছুই বুঝা গেল না।
বেলুর এই অবস্থা দেখে, নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখতে প্রচণ্ড রাগে কাঁপতে-কাঁপতে মিঠুন-ওস্তাদ পকেট থেকে একটি ছোরা বের করে বরিদ্দার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। ভয়ে বরিদ্দা তার রিক্সা ছেড়ে দূরে সরে দাঁড়াল। মিঠুন-ওস্তাদ কোনও কথা না বলে রিক্সাতে গিয়ে উঠল আর সেটি চালিয়ে নিয়ে যেতে লাগল। ধমকের সুরে বলল, "শালা বরিদ্দা, আমাদের ভিক্ষা দান! যা:, তোর রিক্সা আমি নিয়ে গেলাম। এই রিক্সা তুই আর কোনও দিন ফেরত পাবি না। আজ এই রিক্সাকেই বেঁচে দেব। শালা বরিদ্দা! আমাদের এক-টাকা, দুই-টাকা ভিক্ষা দিস; মজা টের পাবি এবার।"
বরিদ্দা পিছন থেকে চীৎকার করে কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু কে শুনে কার কথা? রিক্সা চালিয়ে ওস্তাদ চলে যেতে লাগল আর বরিদ্দাকে খুব করে গালি দিতে লাগল, "শালা বরিদ্দা, আজ শনির দশা লাগল তোর, মজা টের পাবি এবার।"
কিন্তু ঘটনাটা হয়ে গেল উল্টা। বরিদ তো খুব মজা পেলই, মিঠুন-ওস্তাদও মজা টের পেল। কারণ, বরিদ্দার রিক্সাতে একটুও ব্রেক ছিল না। রাগের মাথায় -ওস্তাদের সেই দিকে হুঁশ ছিল না। তাই ঐ টিলা থেকে নামার সময় রিক্সা-যন্ত্রটি হঠাৎ গেল খুব ক্ষেপে, আর লাফিয়ে-লাফিয়ে খুব ছুটতে লাগল, যেন তার মাথায় দৌড়-ভুত চাপে বসছে। সে আর কারোর কথাই শুনল না; মিঠুন-ওস্তাদের কথাও না। পাহাড়ি উন্মাদ ঝর্ণার মত উল্কার গতিতে হুর-হুর করে লাফিয়ে-লাফিয়ে নিচে নামতে লাগল রিক্সাটি। সামনে পাথর, না কি গাছ; কিছুই সে দেখল না, মানল না; ঝড়ের গতিতে ছুটতে লাগল; লক্ষ্য ভগবানের শেষ সীমানা নির্দেশ। মিঠুন-ওস্তাদ শক্ত করে স্টিয়ারিং ধরে শুধু চীৎকার করতে লাগল, "অইত-অইত, আরে- আরে..।" বরিদের মিঠুন-ওস্তাদ স্বয়ং এবার দৈবাধীন।
'আরে-আরে, অইত-অইত' করতে-করতে নক্ষত্র গতিতে রিক্সা সমেত মিঠুন-ওস্তাদ উতলা ক্ষেতের মাঝে উল্টে গিয়ে পড়ল। উতলার মাঝে রিক্সা তো গেল আটকে, কিন্তু ভৌত-বিজ্ঞানের জাড্য ধর্ম মেনে, ওস্তাদজী শুঁ করে বাজ পাখির মত হাওয়ার মাঝে উড়ে গেল। সেই সাত-সকালে দুর্ঘটনা এখানেই যদি শেষ হয়ে যেত, তবে তো কোন কথাই ছিল না, কিন্তু দুর্ঘটনাটি এখানেই শেষ হল না। গ্রামের জেলে হরি বর্মণ সকাল-সকাল তার কনি-জাল নিয়ে বের হয়েছিল পাশের ছড়াতে মাছ ধরতে। ছড়ায় যেতে-যেতে ক্ষেতের আইলে কনি-জালটি রেখে হরি বর্মণ উতলাতে নেমেছিল লাটি মাছ ধরতে। হঠাৎ চোখের পলকে পিছন থেকে হুর-হুর শব্দ করতে-করতে এই বড় একটা কী যেন উড়ে এসে ধুপ করে তার পিঠে পড়ল আর তাকে উতলার মাঝে চেপে ধরল। "ভুত! সকাল-সকাল! ভুতের আক্রমণ! বাপরে বাপ!" দিশা-বিশা না পেয়ে, 'পড়ি কি মরি' হয়ে কাদায় লুটি-পুটি খেতে-খেতে, জাল-জুল ফেলে হরি বর্মণ ক্ষেত কোনাকুনি দৌড় যে একটা মারল, তখন হরি বর্মণের কোনও হুঁশ-জ্ঞান নেই। ভুতকে খিস্তি মারতে-মারতে ঊর্ধ্বশ্বাসে সে ছুটছে। ভুত করেছে হরিকে তাড়া। আ-ও, আ-ও চীৎকার করতে-করতে চোখের পলকেই হরি ক্ষেত-মাঠ পেড়িয়ে হাওয়া। শুধু তার তার পড়নের গামছাটি উতলার মাঝে আটকে গিয়ে ওখানেই পড়ে রইল।