সুফিয়া কামাল, সুবোধ সরকার ও সুভাষ মুখোপাধ্যায় এর কবিতা

in sufiasubodhsuvas •  5 years ago 

 তাহারেই পড়ে মনেসুফিয়া কামাল 

 “হে কবি! নীরব কেন-ফাল্গুন যে এসেছে ধরায়,
বসন্তে বরিয়া তুমি লবে না কি তব বন্দনায়?”
কহিল সে স্নিগ্ধ আঁখি তুলি-
“দখিন দুয়ার গেছে খুলি?
বাতাবী নেবুর ফুল ফুটেছে কি? ফুটেছে কি আমের মুকুল?
দখিনা সমীর তার গন্ধে গন্ধে হয়েছে কি অধীর আকুল?”

“এখনো দেখনি তুমি?” কহিলাম “কেন কবি আজ
এমন উন্মনা তুমি? কোথা তব নব পুষ্পসাজ?”
কহিল সে সুদূরে চাহিয়া-
“অলখের পাথার বাহিয়া
তরী তার এসেছে কি? বেজেছে কি আগমনী গান?
ডেকেছে কি সে আমারে? -শুনি নাই,রাখিনি সন্ধান।”কহিলাম “ওগো কবি, রচিয়া লহ না আজও গীতি,
বসন্ত-বন্দনা তব কণ্ঠে শুনি-এ মোর মিনতি।”
কহিল সে মৃদু মধুস্বরে-
“নাই হ’ল, না হোক এবারে-
আমার গাহিতে গান! বসন্তরে আনিতে ধরিয়া-
রহেনি,সে ভুলেনি তো, এসেছে তো ফাল্গুন স্মরিয়া।”কহিলাম “ওগো কবি, অভিমান করেছ কি তাই?
যদিও এসেছে তবু তুমি তারে করিলে বৃথাই।”
কহিল সে পরম হেলায়-
“বৃথা কেন? ফাগুন বেলায়
ফুল কি ফোটে নি শাখে? পুষ্পারতি লভে নি কি ঋতুর রাজন?
মাধবী কুঁড়ির বুকে গন্ধ নাহি? করে নি সে অর্ঘ্য বিরচন?”“হোক, তবু বসন্তের প্রতি কেন এই তব তীব্র বিমুখতা?”
কহিলাম “উপেক্ষায় ঋতুরাজে কেন কবি দাও তুমি ব্যথা?”
কহিল সে কাছে সরি আসি-
“কুহেলী উত্তরী তলে মাঘের সন্ন্যাসী-
গিয়াছে চলিয়া ধীরে পুষ্পশূন্য দিগন্তের পথে
রিক্ত হস্তে। তাহারেই পড়ে মনে, ভুলিতে পারি না কোন মতে।” 

.

 শাড়িসুবোধ সরকার 

 বিয়েতে একান্নটা শাড়ি পেয়েছিল
মেয়েটা
অষ্টমঙ্গলায় ফিরে এসে আরো ছটা
এতো শাড়ি একসঙ্গে সে জীবনে দেখেনি।
আলমারির প্রথম থাকে সে রাখলো সব
নীল শাড়িদের
হালকা নীল একটা কে জড়িয়ে ধরে বলল,
তুই আমার আকাশ
দ্বিতীয় থাকে রাখল সব গোলাপীদের
একটা গোলাপীকে জড়িয়ে সে বলল, ‘
তোর নাম অভিমান’
তৃতীয় থাকে তিনটি ময়ূর, যেন তিন দিক
থেকে ছুটে আসা সুখ
তেজপাতা রং যে শাড়িটার, তার নাম
দিল বিষাদ ।
সারা বছর সে শুধু শাড়ি উপহার পেল
এত শাড়ি সে কি করে এক
জীবনে পড়বে ?
কিন্তু বছর যেতে না যেতেই ঘটে গেল
সেই ঘটনাটা
সন্ধের মুখে মেয়েটি বেরিয়েছিল
স্বামীর সঙ্গে, চাইনিজ খেতে ।
কাপড়ে মুখ
বাঁধা তিনটি ছেলে এসে দাঁড়ালো
স্বামীর তলপেটে ঢুকে গেল
বারো ইঞ্চি
ওপর থেকে নীচে। নীচে নেমে ডান
দিকে ।
যাকে বলে এল ।
পড়ে রইলো খাবার, চিলি ফিস
থেকে তখনও ধোঁয়া উড়ছে ।
-এর নাম রাজনীতি, -বলেছিল পাড়ার
লোকেরা ।
বিয়েতে একান্নটা শাড়ি পেয়েছিল
মেয়েটা
অষ্টমঙ্গলায় ফিরে এসে আরো ছটা
একদিন দুপুরে শাশুড়ি ঘুমিয়ে, সমস্ত
শাড়ি বের করে
ছতলার বারান্দা থেকে উড়িয়ে দিল
নীচের পৃথিবীতে ।
শাশুড়ি পড়িয়ে দিয়েছেন
তাকে সাদা থান
উনিশ বছরের একটা মেয়ে সে একা ।
কিন্তু সেই থানও এক ঝটকায় খুলে নিল
তিনজন, পাড়ার মোড়ে
একটি সদ্য নগ্ন
বিধবা মেয়ে দৌড়াচ্ছে আর চিৎকার
করছে, ‘বাঁচাও’
পেছনে তিনজন, সে কি উল্লাস, নির্বাক
পাড়ার লোকেরা ।
বিয়েতে একান্নটা শাড়ি পেয়েছিল
মেয়েটা
অষ্টমঙ্গলায় ফিরে এসে আরো ছটা…. 

.

 ফুল ফুটুক না ফুটুকসুভাষ মুখোপাধ্যায় 

 ফুল ফুটুক না ফুটুক
আজ বসন্ত।

শান-বাঁধানো ফুটপাথে
পাথরে পা ডুবিয়ে এক কাঠখোট্টা গাছ
কচি কচি পাতায় পাঁজর ফাটিয়ে
হাসছে।ফুল ফুটুক না ফুটুক
আজ বসন্ত।আলোর চোখে কালো ঠুলি পরিয়ে
তারপর খুলে –
মৃত্যুর কোলে মানুষকে শুইয়ে দিয়ে
তারপর তুলে –
যে দিনগুলো রাস্তা দিয়ে চলে গেছে
যেন না ফেরে।গায়ে হলুদ দেওয়া বিকেলে
একটা দুটো পয়সা পেলে
যে হরবোলা ছেলেটা
কোকিল ডাকতে ডাকতে যেত
– তাকে ডেকে নিয়ে গেছে দিনগুলো।লাল কালিতে ছাপা হলদে চিঠির মত
আকাশটাকে মাথায় নিয়ে
এ-গলির এক কালোকুচ্ছিত আইবুড়ো মেয়ে
রেলিঙে বুক চেপে ধ’রে
এই সব সাত-পাঁচ ভাবছিল –ঠিক সেই সময়
চোখের মাথা খেয়ে গায়ে উড়ে এসে বসল
আ মরণ ! পোড়ারমুখ লক্ষ্মীছাড়া প্রজাপতি !তারপর দাড়ম করে দরজা বন্ধ হবার শব্দ।
অন্ধকারে মুখ চাপা দিয়ে
দড়িপাকানো সেই গাছ
তখন ও হাসছে। 

Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!