আঠারো বছর বয়স – সুকান্ত ভট্টাচার্য
আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ
র্স্পধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি,
আঠারো বছর বয়সেই অহরহ
বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি।
আঠারো বছর বয়সের নেই ভয়
পদাঘাতে চায় ভাঙতে পাথর বাধা,
এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয়-
আঠারো বছর বয়স জানে না কাঁদা।এ বয়স জানে রক্তদানের পুণ্য
বাষ্পের বেগে স্টিমারের মতো চলে,
প্রাণ দেওয়া-নেওয়া ঝুলিটা থাকে না শূন্য
সঁপে আত্মাকে শপথের কোলাহলে।আঠরো বছর বয়স ভয়ঙ্কর
তাজা তাজা প্রাণে অসহ্য যন্ত্রণা,
এ বয়সে প্রাণ তীব্র আর প্রখর
এ বয়সে কানে আসে কত মন্ত্রণা।আঠারো বছর বয়স যে দুর্বার
পথে প্রান্তরে ছোটায় বহু তুফান,
দুর্যোগে হাল ঠিক মতো রাখা ভার
ক্ষত-বিক্ষত হয় সহস্র প্রাণ।আঠারো বছর বয়সে আঘাত আসে
অবিশ্র্রান্ত; একে একে হয় জড়ো,
এ বয়স কালো লক্ষ দীর্ঘশ্বাসে
এ বয়স কাঁপে বেদনায় থরোথরো।তব আঠারোর শুনেছি জয়ধ্বনি,
এ বয়স বাঁচে দুর্যোগে আর ঝড়ে,
বিপদের মুখে এ বয়স অগ্রণী
এ বয়স তবু নতুন কিছু তো করে।এ বয়স জেনো ভীরু, কাপুরুষ নয়
পথ চলতে এ বয়স যায় না থেমে,
এ বয়সে তাই নেই কোনো সংশয়-
এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে।।
.
সংগ্রাম চলবেই – সিকান্দার আবু জাফর
জনতার সংগ্রাম চলবেই,
আমাদের সংগ্রাম চলবেই।হতমানে অপমানে নয়, সুখ সম্মানে
বাঁচবার অধিকার কাড়তে
দাস্যের নির্মোক ছাড়তে
অগণিত মানুষের প্রাণপণ যুদ্ধ
চলবেই চলবেই,
আমাদের সংগ্রাম চলবেই।প্রতারণা প্রলোভন প্রলেপে
হ’ক না আঁধার নিশ্ছিদ্র
আমরা তো সময়ের সারথী
নিশিদিন কাটাবো বিনিদ্র।দিয়েছি তো শান্তি আরও দেবো স্বস্তি
দিয়েছি তো সম্ভ্রম আরও দেবো অস্থি
প্রয়োজন হ’লে দেবো একনদী রক্ত।
হ’ক না পথের বাধা প্রস্তর শক্ত,
অবিরাম যাত্রার চির সংঘর্ষে
একদিন সে-পাহাড় টলবেই।
চলবেই চলবেই
আমাদের সংগ্রাম চলবেইমৃত্যুর ভর্ৎসনা আমরা তো অহরহ শুনছি
আঁধার গোরের ক্ষেতে তবু তো’ ভোরের বীজ বুনছি।
আমাদের বিক্ষত চিত্তে
জীবনে জীবনে অস্তিত্বে
কালনাগ-ফণা উৎক্ষিপ্ত
বারবার হলাহল মাখছি,
তবু তো ক্লান্তিহীন যত্নে
প্রাণে পিপাসাটুকু স্বপ্নে
প্রতিটি দণ্ডে মেলে রাখছি।
আমাদের কি বা আছে
কি হবে যে অপচয়,
যার সর্বস্বের পণ
কিসে তার পরাজয় ?
বন্ধুর পথে পথে দিনান্ত যাত্রী
ভূতের বাঘের ভয়
সে তো আমাদের নয়।হতে পারি পথশ্রমে আরও বিধ্বস্ত
ধিকৃত নয় তবু চিত্ত
আমরা তো সুস্থির লক্ষ্যের যাত্রী
চলবার আবেগেই তৃপ্ত।
আমাদের পথরেখা দুস্তর দুর্গম
সাথে তবু অগণিত সঙ্গী
বেদনার কোটি কোটি অংশী
আমাদের চোখে চোখে লেলিহান অগ্নি
সকল বিরোধ-বিধ্বংসী।
এই কালো রাত্রির সুকঠিন অর্গল
কোনোদিন আমরা যে ভাঙবোই
মুক্ত প্রাণের সাড়া জানবোই,
আমাদের শপথের প্রদীপ্ত স্বাক্ষরে
নূতন সূর্যশিখা জ্বলবেই।
চলবেই চলবেই
আমাদের সংগ্রাম চলবেই।
.
এক গুচ্ছ চাবি – সলিল চৌধুরী
উত্তরাধিকার সূত্রে
পেয়েছি শুধু এক গুচ্ছ চাবি
ছোটো-বড়ো মোটা-বেঁটে
নানারকমের নানা ধরনের চাবি
মা বললেন, যত্ন করে তুলে রেখে দে…
তারপর যখন বয়স বাড়লো
জীবন এবং জীবিকার সন্ধানে
পথে নামতে হোল
পকেটে সম্বল শুধু সেই এক গুচ্ছ চাবি
ছোটো বড়ো মোটা বেঁটে
নানারকমের নানা ধরনের চাবি……কিন্তু যেখানেই যাই
সামনে দেখি প্রকান্ড এক দরজা
আর তাতে ঝুলছে
প্রকান্ড এক তালা
পকেট থেকে চাবির গুচ্ছ বের করি
এ চাবি সে চাবি
ঘোরাই ফেরাই-লাগেনা-খোলেনা
শ্রান্ত হয়ে ঘরে ফিরি-
মা দেখেন আর হাসেন
বলেন-‘ওরে তোর-বাবার-হাতেও
ঐ চাবি দিয়ে ঐ দরজাগুলো খোলেনি-
শুনেছি নাকি তাঁর বাবার- হাতে খুলত…আসল কথা কি জানিস?
এ সব চাবি হোল
সততার সত্যের যুক্তির নিষ্ঠার
এসব দরজাগুলো খোলেনা…তবুও তুই ফেলে দিস্ না
তুই যখন চলে যাবি
তোর সন্তানদের হাতে দিয়ে যাস
এসব চাবির গুচ্ছ-হয়তো তাদের হাতে
হয়তো কেন নিশ্চয়ই তাদের হাতে একদিন
ঐসব সততার সত্যের যুক্তির নিষ্ঠার চাবি দিয়ে
জীবনের বন্ধ দরজাগুলো
খুলে যাবে-খুলে যাবেই….’