বৈশাখীর বাড়ির সামনে ট্যাক্সি থেকে নেমেই অর্ক বেশ কিছুটা অবাক হয়ে গেলো । বাড়িরটার বেশ ছন্নছাড়া চেহারা হয়েছে । পাঁচ বছর আগেও এমনটি ছিল না । বাড়ির মেন গেট পেরিয়ে কিছুটা এগোলেই দু'পাশে প্রচুর ফুলের কেয়ারি ছিলো এক সময় । আর বাড়ির সদর দরজার দু'পাশে ছিল অনেকগুলি ফুলের টব । কিছুই এখন আর নেই । লনে শুধু প্রচুর ঘাস জন্মেছে ।
দীর্ঘদিন রঙ না করা সাবেকি ঢঙে করা বিশাল বাড়িটা আজকে যেন জীর্ন হয়ে ধুঁকছে । বৈশাখীর ভাই এখানে থাকে না । দিল্লিতে এক বড় বেসরকারি হসপিটালের ডাক্তার সে । আলতো করে কলিংবেলের সুইচে আঙুল রাখলো অর্ক । কয়েক মুহূর্তের দ্বিধা । এরপরে বেল বাজালো । একবার বাজিয়েই wait করতে লাগলো ।
বেশ কিছুক্ষন সময় অতিবাহিত হলো । এমন সময় দরজা খুলে গেলো । বৈশাখীর মা দাঁড়িয়ে । উনি অর্ককে ভেতরে আসতে বললেন ।
ঢুকেই প্রকান্ড ড্রয়ইং রুম । সোফায় বসে বছর তিনিকের একটি মিষ্টি মেয়ে খেলা করছে বৈশাখীর বাবার সঙ্গে । অর্কের সাথে কুশল বিনিময় হলো বৈশাখীর বাবার । মেয়েটাকে একটু গাল টিপে আদর করলো অর্ক । তারপরে জানতে চাইলো বৈশাখী কোথায় ।
বৈশাখীর মা জানালেন বৈশাখী তার রুমেই আছে ।
একটু ইতস্তত করে অর্ক সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে বৈশাখীর রুমের দরজায় নক করলো । এক মুহূর্তের অপেক্ষা । সহসা দরজা খুলে গেলো । ধীর পায়ে বৈশাখী এসে দাঁড়িয়েছে খোলা দরজার ওপারে ।
নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো শুধু দু'জন দু'জনের দিকে । এতো কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে দু'জনে তবু মনে হচ্ছে দু'জনের মধ্যে এক সমুদ্র দূরত্ব রয়েছে আজ । হাতে হাত রাখার, বুকে জড়িয়ে ধরার কোনো অধিকার নেই আজ তাদের কারোরই ।
বেশ কিছুক্ষন পরে নীরবতা ভাঙ্গলো বৈশাখীই । ক্লান্ত ভগ্ন স্বরে বললো - "ভেতরে এসো ।"
ধীরপায়ে রুমে ঢুকলো অর্ক । বৈশাখী রুমের আলো কিছুটা বাড়িয়ে দিলো । অর্ককে বেডে বসতে দিয়ে নিজে একটি চেয়ার টেনে তার সামনে বসলো । কিছুক্ষন নীরবতা । অর্ক লক্ষ করলো বৈশাখীর চোখের কোলে এখনো জল, দুই গালে জলের রেখা এখনো মুছে যায়নি ।
সীমাহীন এক নৈঃশব্দ্য ঘিরে রইলো দু'জনকে । সহসা দু'জনেই সব কথা হারিয়ে ফেলেছে । জীবনের সব কথা ফুরিয়েছে যেনো, কিছু নেই বলার, কিছু নেই শোনার । বেশ কিছুক্ষন পরে বৈশাখীই কথা বললো -
"অনেক রোগা হয়ে গিয়েছো তুমি ।"
জবাবে মৃদু স্বরে অর্ক বললো -
"তুমিও তো অনেক রোগা হয়ে গিয়েছো ।"
প্রত্যুত্তরে বৈশাখী কিছুই বললো না শুধু একটু বোকাটে হাসি দিলো । সেই হাসিতে যে কী এক সীমাহীন বেদনা লুকিয়ে ছিলো তা অর্কের চোখে ধরা পড়লো । সহসা অর্ক বৈশাখীর নরম কোমল শীর্ণ হাতটা নিজের হাতের মুঠিতে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে ফেললো । বৈশাখীও আর নিজেকে সামলাতে পারলো না । ঝাঁপিয়ে পড়ে অর্কের বুকে মাথা রেখে ডুকরে কেঁদে উঠলো । এই তার পরম আশ্রয়স্থল যা সে জেদের বশে ত্যাগ করেছিল সেদিন ।
অর্ক বাধা দিলো না । কাঁদুক । বৈশাখী কাঁদুক । কেঁদে কেঁদে যদি মনটা হালকা হয় । সে নিজেও তো কাঁদছে । বাঁধভাঙা অশ্রুর জোয়ারে প্লাবিত হচ্ছে তার দুই গাল । এক সময় দু'জনেই নিজেদেরকে সামলে নিলো । চোখ মুছে ধরা গলায় বৈশাখী বললো -
"তোমার বিয়ে কবে অর্ক ? আমাকে তো এখনো কার্ড দিলে না ?"
সহসা যেন ইলেকট্রিক শক খেলো অর্ক -
"তুমি তুমি ...."
-"জানলাম কি করে তাই ? পারো আমার ছোট বোন হয় । ছোট মাসির মেয়ে । তোমাকে কোনোদিন বলা হয়নি ।"
-"কি বলছো কি তুমি ? তুমি সব জানো ?"
-"হ্যাঁ, অর্ক আমি জানবো না তাই কি হয় ? গত পাঁচটি বছর ধরে আমি তোমার খোঁজ খবর খেয়াল সবই রেখেছি । তুমি রাখোনি । চাইলেই পারতে রাখতে তুমি । কিন্তু, আমি যে অন্যায় করেছি তাতে তুমি আমার খোঁজ খবর রাখবে না সেটা আমিও মেনে নিয়েছিলাম । তাই কোনোদিনও রাগ অভিমান হয়নি । কিন্তু, কষ্ট হয়েছিল খুব । বিশ্বাস করো । খুব কষ্ট ।"
কী বলবে অর্ক ! সে শুধু খোঁজ নেয়নি বৈশাখীর এই জন্য যাতে বৈশাখীর জীবনে অতীত কখনো ছায়া না ফেলতে পারে । তার সংসারে যেন কোনো আঁচ না পড়ে । অর্ক চেয়েছিলো বৈশাখী সুখে থাকুক । সে জন্যই সে কোনোদিনও বৈশাখীর খোঁজ নেয়নি । বড়লোকের ছেলে, আমেরিকায় সেটলড, ভালো জব করে । সুতরাং, সহজ সরল অর্ক ভেবেই নিয়েছিল যে বৈশাখী সুখেই আছে ।
অর্ক কিছুই বললো না তাই । শুধু মাথা নিচু করে নীরব রইলো । আবার নীরবতা গ্রাস করলো দু'জনকে । নীরবতা ভঙ্গ করে সহসা বৈশাখী বললো -
"যাই তোমার জন্য চা-টা কিছু আনি । কতকাল পরে তুমি এলে বোলো ?"
চেয়ার ছেড়ে উঠতে গেলেই বৈশাখীর হাতটি হঠাৎ অর্ক ধরে জোর করে নিজের পাশে এনে বসালো -
"মৌ, আমি তোমাকে আবার চাই আমার জীবনে । আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই ।"
"মৌ", কতকাল পরে এই ডাকটা শুনলো বৈশাখী অর্কর মুখে । তার বুকের ভেতরটা উথাল পাথাল করছে । খুব, ইচ্ছে করছে অর্ককে বুকে জড়িয়ে আদরে আদরে ভরিয়ে দিতে । কিন্তু, তার মাসতুতো বোনের কি হবে তাহলে ? অন্য কোনো মেয়ের সাথে যদি অর্কর বিয়ে ঠিক হতো তবে, সে অর্কর আজকের প্রস্তাবে সাড়া দিতো অনায়েসেই । কারণ, সে অর্ককে ছাড়া জীবনে আর কোনো পুরুষকে তো ভালোবাসেনি । আর ভালোবাসার মানুষটার সাথে ঘর করতে কোন মেয়েই না চায় ?
-"না, তা আর হয় না অর্ক ।", খুব ধীর স্বরে বললো বৈশাখী ।
"কেন হয় না মৌ ? কেন ?", অর্ক কেঁদে ফেললো ।
"যে নীড় নষ্ট হয়ে গিয়েছে সেখানে আর ফিরে আসতে নেই । তাকে পরিত্যাগ করে নতুন করে অন্য কোথাও ভালোবাসার নীড় বাঁধতে হয় । পারো আমার বোন হয় । সে সব কিছুই জানে । তাকে এই বিয়েতে রাজি করিয়েছি আমি । তবে, সে তোমাকে সত্যি সত্যিই ভালোবাসে । তোমার একটু আগের পাঠানো মেসেজটা পেয়ে মেয়েটা খুব কেঁদেছে । আমি তাই তোমার কাছে আমার ভালোবাসার ভিক্ষা চাইছি । ভিক্ষা দাও আমাকে । আমার বোনকেই তুমি বিয়ে করে সংসার করবে । দেবে না কথা ? প্লিজ, সোনা !"
কাঁদতে কাঁদতে অর্ক বললো - "আর তুমি ?"
"আমার জন্য ভেবোনা তুমি । আমি তো এখন বাবা-মায়ের কাছেই থাকবো । আর আমি তো এখন আর একা নই । তুমি আছো, পারো আছে । আমি ঠিকই থাকবো । অন্তত বেঁচে তো থাকবো । মেয়েটাকে মানুষ করতে পারলেই আমার ছুটি ।"
বৈশাখীর বুকের ভেতরটা একটা জমাট বাঁধা বরফের পিন্ড এখন । নিজের প্রিয়তমকে অন্যের হাতে তুলে দিতে কয়টা মেয়েই পারে ! বৈশাখী পেরেছে । তবে, এই আঘাত সে আর সামলাতে পারবে না, সে কথা খুব ভালো করেই জানে । অর্কের জন্য সব চাইতে বেশি কষ্ট হচ্ছে । এত ভালোবাসে ছেলেটা তাকে, আর সে শুধু বঞ্চনাই করে গেলো তাকে । ব্যর্থ জীবন তার । সব কিছুতেই চরমভাবে ব্যর্থ বৈশাখী ।
অনেক রাতে বাড়ি ফিরে এলো অর্ক । ঘুমের আগে মোবাইলে মেসেজ চেক করলো অর্ক । দুটি মেসেজ এসেছে । একটি বৈশাখীর, আরেকটি পারমিতার । আগে বৈশাখীর মেসেজ চেক করলো ।
"প্রিয়তম তোমায় আমি ত্যাগ করেছি, কিন্তু, প্লিজ আমায় ত্যাগ করো না । জানি কিছুদিন পরে তুমি অন্যের হয়ে যাবে, তারপরেও আমারই থাকবে ।"
পারমিতার মেসেজ চেক করলো এরপরে অর্ক কাঁপা কাঁপা হাতে -
"তুমি শুধু আমার । শুধুই আমার । আর কারো নও । আর যেন কখনোই দিদির বাড়িতে যেতে না দেখি ।"
রুমের লাইট অফ করে দিলো অর্ক । তার এখন বড্ড আঁধার প্রয়োজন । নিজেকে হারাতে চায় নিকষ কালো আঁধারের বুকে -