রবীন্দ্রনাথের "চিত্রাঙ্গদা" আর মানসুরা হোসাইনের লেগুনা-চালক মুক্তি রানী দাশ : আ জার্নি টুওয়ার্ডস লাইফ.........
"আমি চিত্রাঙ্গদা,
আমি রাজেন্দ্রনন্দিনী!
পূজা করি মোরে রাখিবে উর্ধ্বে
সে আমি নহি।
হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে
সে নহি নহি।
যদি পার্শ্বে রাখ মোরে
সঙ্কটে সম্পদে,
সম্মতি দাও যদি কঠিন ব্রতে
সহায় হতে,
পাবে তবে তুমি চিনিতে মোরে.....
-------"চিত্রাঙ্গদা''র শেষ গান/রবীন্দ্রনাথ।
-----পৃথিবীর মাটি থেকে আট হাজার ফুট ওপরে, ঘন্টায় একহাজর দু'শো কিলোমিটার গতি নিয়ে উড়ে চলছে ২৩০ আসনের এয়ারক্রাফট, "স্কাই বার্ড"!
সামনে দিগন্ত-বিস্তৃত নি:সীম নীলাকাশ। মাঝে মাঝেই আকাশে ভাসছে নরম আর ধবধবে সাদা ছোটবড় সব মেঘের ভেলা.......
আকাশের গাঢ় নীল রং, মাঝে মাঝে উড়ন্ত মেঘরাজির ধবধবে সাদা রং আর চারপাশের শূণ্যতা ইত্যাদি মিলেমিশে এক অনুপম নৈসর্গিক সৌন্দর্য!
ডানা মেলা স্কাইবার্ড কখনও ভাসমান মেঘের নিচ দিয়ে, কখনও নরম পেজা মেঘ কেটে, আবার কখনও মেঘের উপর দিয়ে সাই সাই শব্দে উড়ে চলছে গন্তব্যের দিকে.......
মাথাভর্তি সিল্কি চুল,বিশেষ ধরণের রেডিও-হেডফোনে আবৃত দু'টি কান, দু'চোখে বড় কালো রংয়ের সানগ্লাস -- এক নারী ফ্লাইট ক্যাপ্টেন ফ্লাইট-ডেক
বা ককপিটে কখনও দাঁড়িয়ে, কখনও সিটে বসে তার দৃষ্টি প্রসারিত করে রেখেছেন সামনের দিকে।
তার লিপস্টিক রাঙানো চওড়া দু'ঠোটের মধ্য দিয়ে মাঝে মাঝেই বেরিয়ে আসছে কন্ট্রোল টাওয়ারের সাথে যোগাযোগের কোড-ল্যাঙ্গুয়েজ,ইংরেজিতে নানা কনভার্সেশন.....
আবার কখনও তিনি কথা বলছেন পাশের সিটের কো-পাইলট বা ফার্স্ট অফিসারের সাথে।কখনও নির্দেশনা দিচ্ছেন ভিতরে থাকা কেবিন ক্রু বা ফ্লাইট এ্যাটেনডেন্টদের।
তার নেইল-পোলিশ রাঙানো দু'হাতের মসৃণ দশটি আঙুলই ব্যস্ত সামনের কন্ট্রোল-প্যানেল জুড়ে থাকা অসংখ্য অপটিক্যাল সুইচ আর কি-বোর্ডে।
চোখ জোড়া দিগন্তের শূণ্যতা থেকে ক্ষণে ক্ষণে নেমে আসছে সামনে সেট করা বিশাল আকারের তিন চারটা কম্পিউটার স্ক্রিণে। সেখানে অনবরত ভেসে উঠছে বিভিন্ন গ্রাফিক্যাল ডিসপ্লে আর জটিল সব এলগারিদম।
ককপিটের পেছনে, একটি কক্ষের পরেই বিশাল প্যাসেঞ্জার্স রুম।সেখানে সারি সারি যাত্রি--নারী,পুরুষ,শিশু!কেউ ঘুমায়,কেউ ঝিমোয়,কেউ কথা বলে,কেউ স্ন্যাকস খায়....
উড়ন্ত বিমান!ককপিটে কর্তব্যরত ক্যাপ্টেন,কো-পাইলট বা ফার্স্ট অফিসারের সামান্যতম একটু ভুলেই ঘটে যেতে পারে ভয়াবহ একটা দুর্ঘটনা,নির্ঘাত ক্রাশ!
তাই কঠিন দায়িত্ববোধ,উঁচুমাত্রার প্রফেশনাল এফিসিয়েন্সি, এক্সপেরিয়েন্স,আর সূক্ষ্ম হিসেব-নিকেষের মধ্য দিয়ে একজন পাইলট বা ফার্স্ট অফিসারকে প্রতিটা উড়ান শেষ করতে হয়।
এভাবে এয়ারপোর্টে সফল ল্যান্ডিংয়ের পরে এয়ারলাইন্স কোম্পানির অপেক্ষমান গাড়িতে চেপে সোজা নির্ধারিত কোন ফাইভ বা সেভেন স্টার হোটেলে গিয়ে বিশ্রাম,রাত্রি যাপনের ফ্রি সুযোগ।
হয়তো আজকের রাতটা মুম্বাই/ব্যাঙ্গালোরের কোন হোটেলে কাটলো তো পরের রাতে দুবাইয়ে।তারপরের দিনটা নিউইয়র্কে তো শেষের রাতটা সিঙ্গাপুর/হংকং-য়ে কাটিয়ে পরের দিন ঢাকায়।কী দারুণ এক গর্জিয়াস আর গ্ল্যামারাস লাইফ!
শুধু তাই নয়।মাস শেষে জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এ্যাভিয়েশন অর্গানাইজেশন (ICAO) কর্তৃক নির্ধারিত স্কেলে লাখ লাখ টাকা বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য অনেক সুযোগ সুবিধা তো আছেই!
তাই বলছিলাম,দারুণ ভার্সেটাইল একটা প্রফেশন এটা।বলতে হয়,ভেরি ল্যুক্রেটিভ এ্যান্ড সফিসটিকেটেড প্রফেশন উইথ আ গর্জিয়াস এ্যান্ড গ্লামারাস লাইফ স্পেশ্যালি ফর আ ওম্যান অব বাংলাদেশ!
তবে কোন একজনের পক্ষে ইন্টারন্যাশনাল বা ডোমেস্টিক ফ্লাইটের পাইলট বা ফার্স্ট অফিসার হওয়াটা মোটেই সহজ নয় কিন্তু।
এ জন্যে প্রচুর অর্থ ব্যয় সাপেক্ষে প্রথমে দেশের এবং পরে বিদেশের ফ্লাইং ক্লাবে ভর্তি হয়ে দীর্ঘ প্রশিক্ষণ কোর্স শেষ করতে হবে।
শহুরে উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষে তো সম্ভবই নয়।রীতিমত ফিনানসিয়াল-এলিট বা বুর্জোয়া শ্রেণির সন্তান ছাড়া এত টাকা কেউ খরচ করতে পারেনা।
অনেক জটিল আর কঠিন সব প্রকৃয়া শেষ করে কমার্শিয়াল পাইলট লাইসেন্স(CPL) অর্জন করতে পারলেই তবে কোন সরকারি বা বেসরকারি এয়ারলাইন অপারেটর চাকুরিতে নিয়োগ দেয়।
আর হ্যাঁ, ব্যয়বহুল এ পেশায় শুধু অর্থ থাকলেই আসা যায় না।এ জন্যে ম্যাথ এবং ফিজিক্সে উঁচুমানের দখল থাকতে হয়।
পাশাপাশি শারীরিক ফিটনেস, কঠিন মানসিক চাপ নেয়ার ক্ষমতা আর সর্বোপরি সততার মত গুণাবলী তো থাকতেই হবে।
কিন্তু স্টোরিটা যদি এমন হয় -- টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার প্রত্যন্ত কোন গ্রাম থেকে অভাব তাড়িত হয়ে কোন হতদরিদ্র পিতা যতীন দাশ তার স্ত্রী, দু'ছেলে আর এক কিশোরী মেয়েকে নিয়ে ঢাকার শহরতলী, সাভারের আশুলিয়ার কোন বস্তিতে এসে উঠেছেন।
সংসার চালাতে নিজে ভাড়ার রিকশা নিয়ে নেমেছেন রাস্তায়,সদ্য কৈশোর পেরোনো ছেলে সজীব আর মিলন করছে অনিয়মিত দিনমজুরি আর কিশোরী মেয়ে মুক্তি রানী পাশের কোন গার্মেন্ট-ফ্যাক্টিরতে মাস্টার রোলের ফ্লোর-ওয়ার্কার,মানে ফ্লোরে বসে নির্দেশমত টুকটাক কাজ করে।
এক সময় রিকশা ছেড়ে মুক্তির বাবা ভাড়ার অটো-রিকশা চালাতে শুরু করেন,ভাইয়েরা অটো-লেগুনার হেলপারি থেকে ড্রাইভারি করে।পিতা যতীন দাশ একদিন রোডে ট্রাকের সাথে সংঘর্ষে স্পট ডেড হন।
এদিকে ক্রমাগত শারীরিক-মানসিক অত্যাচার,হেনস্থা আর অনিয়মিত ও স্বল্প বেতনের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে ঘুরে দাঁড়ায় মুক্তি।ছেড়ে দেয় গার্মেন্ট শ্রমিকের কাজটুকু।
ভাইদের সহযোগিতায় অটো-লেগুনা ড্রাইভিং শিখতে শুরু করে।
অনেকটা দ্রুতই ড্রাইভিংটা শিখে ফেলে মুক্তি। দু'বছর চেষ্টা করে সংগ্রহ করে বিআরটিএ'র ড্রাইভিং লাইসেন্সটাও।
গার্মেন্ট-ওয়ার্কার স্বামীর সামন্য সঞ্চয়,আশপাশের লোকজনের কাছ থেকে কিছু ধার গ্রহণ আর এনজিও থেকে লোন করা টাকা মিলিয়ে দেড়লাখ টাকায় কিনে ফেলে একটা পুরাতন লেগুনা।
আর দেরি নয়।মুক্তি রানী নেমে পড়ে রাস্তায়।
আশুলিয়া,জিরাবো,জামগড়া,
নরসিংহপুর,নবীনগর,বাইপাইল রুটে ছুটে চলে তার লেগুনা।কোন হেলপার নেই -- নিজেই প্যাসেঞ্জার ডাকা,তোলা,ভাড়া তোলা সব করেন।
ঘুপচি অন্ধকার পরিবেশে একটি কক্ষের ভাড়ার বাসা।ভোররাতে উঠে কোন রকমমে রান্না-বান্না সেরে নেয়। তারপর নিজে কিছু খেয়ে আর স্বামী তপনকে খাইয়ে বের হন নিজের লেগুনা নিয়ে।
পরিধানে সস্তা দামের স্যালোয়ার-কামিজ-ওড়না,গলায় ঝোলানো ল্যামিনেটেড ড্রাইভিং লাইসেন্স।চোখেমুখে কঠোর একটা অভিব্যক্তি নিয়ে, স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে মুক্তি ছুটে চলে পিচঢালা পথে.......
পথের রোদ,ধুলোবালি,নানা লোকের কুমন্তব্য আর বিভিন্ন রকম টিজিং, খাওয়া-দাওয়ার কষ্টসহ এক শরীর ক্লান্তি নিয়ে সেই রাত দশটায় বাসায় ফেরা।
গত ২৭ এপ্রিল একটি জাতীয় দৈনিকের একজন কন্ট্রিবিউটর, মানসুরা হোসাইন এমনই এক মুক্তি রানীকে আমাদের সামনে সবিস্তারে তুলে ধরেছেন।
আবার একটা চিত্র যদি এমন হয় -- বরিশালের কোন প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে অভাবের টানে উঠে আসা ডিভোর্সি রোজিনা গার্মেন্ট-শ্রমিকের কাজ ফেলে ঢাকার রাস্তায় রিকশা চালাচ্ছে।
তার শরীরে ঢিলেঢালা পাঞ্জাবি-পাজামা আর মাথায় গামছা বা টুপি।দেখে বোঝার উপায় নেই যে সে একজন নারী। পুরুষের বেশে রিকশা চালাচ্ছে।
এভাবে উপার্জিত অর্থে স্বামী পরিত্যক্তা রোজিনা তার সংসার চালিয়ে আবার দু'টি সন্তানকে ঢাকা শহরেরই স্কুলে পড়াচ্ছে........
-------তোমার শোনানো এই তিনটি স্টোরিই নি:সন্দেহে খুবই টাচিং।
বিশেষত: আশুলিয়ার লেগুনা চালক মুক্তি রানী আর পুরুষবেশী রিকশা চালক রোজিনার জীবন সংগ্রাম আমার কাছে হার্ট-ব্রেকিং এবং সামাজিক বাস্তবতার নিরিখে রীতিমত রেভ্যুলেশনারি।
একইসঙ্গে এরা এক্সেপশনাল এবং এ্যাডভেঞ্চারাসও।স্যালুট ওদের!
বিমানে ক্যাপ্টেন/পাইলট বা ফার্স্ট অফিসার হওয়া সত্যিই খুব কঠিন।আর সন্দেহ নেই যে, এ পেশাটিও খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এটাও জানি, সফিসটিকেটেড এ পেশাটি বিত্তবান ও মেধাবীদের জন্যই।
তবে অতি সম্প্রতি একজন নারী পাইলট(ফার্স্ট অফিসার) তার জাল একাডেমিক সনদের কারণে বরখাস্ত হয়েছেন বলে মূলধারার ও সোশ্যাল মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
ভাবা যায়,ঐ মহিলা পাইলট নাকি আবার একজন সিনিয়র পাইলটের স্ত্রী? বিচার এড়াতে ইতোমধ্যে তিনি নাকি দেশের বাইরে চলে গেছেন।
গণিত আর পদার্থবিদ্যায় উঁচুমানের দক্ষতা থাকার বাধ্যতামূলক শর্ত থাকলেও ঐ মহিলা উচ্চমাধ্যমিকে সায়েন্স নিয়ে পড়েনইনি,ছিলেন মানবিকের ছাত্রী।
অভিযোগ উঠেছে,তিনি তার জন্য বিজ্ঞান বিভাগের একটি জাল সনদ তৈরী করে সেটি দিয়ে ফ্লাইং ক্লাবে ভর্তি হয়েছেন এবং পরে লাইসেন্সও পেয়ে চাকুরিতে ঢুকেছেন।
কলেজ এবং শিক্ষাবোর্ডের নথি দেখে এমনটাই নাকি পাওয়া গেছে।
আসলে এসব ক্ষেত্রে মেধা নয়,বাপের অঢেল টাকার জোর আর স্বামীর প্রভাব প্রতিপত্তি থাকাটাই বড় কথা হয়তো।
তাছাড়া সোনাসহ মাদক দ্রব্য পাচারে যুক্ত থাকার জন্যও দেশ-বিদেশের অনেক এ্যাভিয়েশন পার্সোনেল বা স্টাফের অভিযুক্ত হওয়ার সংবাদ পাওয়া যায়।
ককপিটে পুরুষ পাইলট আর মহিলা পাইলট বা এয়ার হোস্টেসদের মধ্যকার রোমান্স বা ফস্টিনস্টির অনেক ঘটনাও মিডিয়ায় চলে আসে।
এইতো গতকালকের আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত খবরটা,যেটা বাংলাদেশের কালের কন্ঠ তাদের ফেইসবুক ভার্সনে শেয়ার করেছে, সেটা দেখে তো আমি হতবাকই!
ইন্ডিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ব খাতের ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনার, "এয়ার ইন্ডিয়ার" একজন পাইলট নীতিমালা ভঙ্গ করে তার এক গার্লফ্রেন্ডকে ককপিটে নিয়ে মজা করেছেন।
এমনকি ককপিটে তার জন্য পান-আহারেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে।এ অভিযোগে ঐ ফ্লাইটে ঐ দিন দায়িত্বরত সকলকে গ্রাউন্ডেড করা হয়েছে।গত মার্চের এ ঘটনায় অভিযুক্ত পাইলটকে শোকজ করা হয়েছে।
------বিমানের ফার্স্ট অফিসার সেই মহিলার বিরুদ্ধে একাডেমিক সনদ জালিয়াতির অভিযোগটি আমিও দেখেছি।
একটি হাইলি সফিসটিকেটেড এবং রিস্কি প্রফেশনের ক্ষেত্রে এধরণের অভিযোগ ওঠা সত্যিই খুব গুরুতর।
তবে যেকোন জালিয়াতি বা প্রতারণার দায় কিন্তু ব্যক্তির -- সরকার বা নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের নয়।
করোনাকালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সেই অভিযুক্ত মহা প্রতারক সাবরিনার কথা মনে আছে?
প্রতারকরা ফাঁক-ফোকর দিয়ে হয়তো সরকারি সিস্টেমে বা প্রতিষ্ঠানে অনেক সময় ঢুকে পড়ে। কর্তৃপক্ষ অনেক সময়েই সেটা ধরতে পারেন না।
তবে ঐ মহিলা পাইলটের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ার সাথে সাথেই কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাকে সাসপেন্ড করেছে।তার বিরুদ্ধে তদন্তও চলমান রয়েছে।
-------যাহোক সমাজের একেবারে উঁচু স্তরের নারীদের টাকার জোরে মহিলা পাইলট হওয়া থেকে
হতদরিদ্র বা প্রলেতারিয়েত শ্রেণি থেকে উঠে আসা লেগুনা-চালক মুক্তি রানী আর পুরুষবেশী মহিলা রিকশাপুলার, রোজিনার
জীবন-সংগ্রাম আমার কাছে বেশি অনুপ্রেরণার,অত্যধিক শ্রদ্ধার।
------কিন্তু লেগুনা-চালক হয়ে মুক্তি রানী আর রিকশা চালক হয়ে রোজিনা কি এমন ব্যতিক্রমি কাজটা করেছে যে তাদের স্টোরিগুলো পত্রপত্রিকা আর সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হচ্ছে?
কোলকাতা,চেন্নাই,ব্যাঙ্গলোর আর দিল্লিতে দেখেছি -- অনেক নারীই ডাবল ডেকার বাস চালাচ্ছে,অটো-টোটো-মোটরসাইকেল ইত্যাদির তো কথাই নেই।
সমগ্র বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে নারীরা কৃষি আর নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করছে না? তো গণপরিবহন লেগুনা আর রিকশা চালানো নিয়ে এত কথা কেন?
-----আসলে বিষয়টা সামাজিক বাস্তবতা বা দৃষ্টিভঙ্গির,মাইন্ডসেটের।
আমাদের চিরচেনা রূপের বাইরে কোন নারী গেলে,চললে বা পোষাক পরলেই আমরা রিপার্ক করি,আর মেনে নিতে পারিনা।
মুক্তি আর রোজিনারা এই মাইন্ডসেট ভাঙ্গার অকুতোভয় সৈনিক!এভাবেই ওরা দেয়াল ভেঙ্গে স্ব-মূর্তিতে বেরিয়ে আসবে,আসছে বলে.......
------নারীর স্ব-মূর্তি কথাটার মানে কি?
-------এ কথার অর্থ হচ্ছে একজন নারী তার নিজস্ব ক্ষমতায়,তার সামর্থ নিয়ে সমাজে বা কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হবে,পুরুষের সাহায্য বা অনুকম্পায় নয়।
পুরুষের পেশা বা নারীর জন্য নির্ধারিত পেশা সম্পর্কিত যে গতানুগতিক ধারণা আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে, সেটা ভেঙ্গে যাবে।
মুক্তি বা রোজিনাদের দিকে কেউ হা করে তাকিয়ে থাকবে না,ওদের স্টোরি ভাইরাল হবেনা।এরকমই একটা সমাজ চাই.......
-------বুঝলাম।তা কি করবেন এখন,জনাব ?
-------অনেকদিন পরে, আজ আবার রবীন্দ্রনাথের ড্যান্স-ড্রামা "চিত্রাঙ্গদা" দেখবো।
--------কী আছে চিত্রাঙ্গদায়?
--------অনেক বড় কিছু আছে --অত্যন্ত শৈল্পিকভাবে আছে নারীর প্রকৃত মর্যাদা আর ক্ষমতায়নের কথা! এটা শুধুমাত্র দূরদর্শী রবীন্দ্রনাথের পক্ষেই সম্ভব।
হিন্দু মাইথোলজি অনুসরণে রচিত ঐ নৃত্যনাট্যটা আমার কাছে অসাধারণ মনে হয়।
বারো বছরের সন্ন্যাসব্রত(ব্রম্মচর্য্য) পালনের এক পর্যায়ে অর্জুন পূর্বভারতের জঙ্গলাকীর্ণ রাজ্য মণিপুরের এক জঙ্গলে উপস্থিত হন।সেখানে তার সাথে দেখা হয় মণিপুর রাজ্যের রাজার তনয়া, চিত্রাঙ্গদার সাথে।
চিত্রাঙ্গদা পুরুষের বেশে ঐ জঙ্গলে তার বন্ধুদের নিয়ে শিকার করতে গিয়েছিলেন।
দেবতা শিব মণিপুররাজকে বর দিয়েছিলেন যে,তার বংশে কেবলমাত্র পুত্রই জন্মাবে।
তা সত্বেও রানীর গর্ভে মেয়ে চিত্রাঙ্গদার জন্ম হলে রাজা তাকে পুরুষের বেশে বড় করতে থাকেন।
অস্ত্রচালনা,শিকার,যুদ্ধবিদ্যা ইত্যাদি পুরুষোচিত কাজে চিত্রাঙ্গদা অচিরেই খুব পারদর্শী হয়ে ওঠেন।
যাহোক এই পুরুষবেশী চিত্রাঙ্গদা সেদিন জঙ্গলে অর্জুন দেখেই প্রেমাসক্ত হয়ে পড়েন।কিন্তু কুরূপা চিত্রঙ্গদাকে অর্জুন সন্ন্যাসব্রত পালনের দোহাই দিয়ে প্রত্যাখান করেন।
কিন্তু হাল ছাড়েননি চিত্রাঙ্গদা।তিনি অর্জুনকে পাওয়ার জন্য রূপ আর কামের দেবতা, মদনের কঠোর আরাধনা শুরু করেন।
একবছর পরে মদন চিত্রাঙ্গদার সামনে হাজির হয়ে তাকে কাঙ্খিত বর প্রদান করলেন।মুহুর্তেই কুরূপা চিত্রাঙ্গদা অত্যন্ত রূপবতী আর পূর্ণযৌবনা নারীতে পরিণত হয়ে যান।
এবার অর্জুনের সামনে গেলে অর্জুন চিত্রাঙ্গদার রূপে বিমোহিত হয়ে যান এবং প্রণয়ে আবদ্ধ হন।
কিন্তু চিত্রাঙ্গদা নিজের মায়ারূপ নিয়ে ভিতরে ভিতরে উদ্বিগ্ন ছিলেন,যদি প্রকৃত কাহিনিটা অর্জুন জেনে যান।
যাহোক অর্জুন ইতোমধ্যে চিত্রাঙ্গদার অন্যান্য ক্ষমতা, দক্ষতা আর নৈপুণ্যের সাথে রাজ্য পরিচালনার কথা জেনে গিয়েছিলেন।
অত:পর অর্জুন চিত্রাঙ্গদাকে তার মায়ারূপ ছেড়ে পূর্বের প্রকৃত নারী রূপেই আবাহন করেন।চিত্রাঙ্গদাও নারী রূপেই অর্জুনের পাশে থাকতে অভিলাষ করেন।
তাই নারীকে তার নারীত্বের শক্তি নিয়েই সমাজ-অর্থনীতি-প্রশাসন আর রাজনীতিতে দেখতে চাই।কোন সহানুভূতি,অনুকম্পা আর অবাক বিস্ময় ভরা চোখে নয়।
মহান মে দিবসের সূচনা করেছিল মার্কিন নারী শ্রমিকরাই।আজকের এই মহান দিবসে মুক্তি-রোজিনাদের আমার সশ্রদ্ধ অভিবাদন!
------আহ্ নারী মুক্তি!
দিন তিনেক আগে '৭১-এর একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও প্রবীণ রাজনীতিক, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী তো টাঙ্গাইলের সখীপুরে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুতে সংশ্লিষ্ট নারী ইউএনও'র নেতৃত্বে গার্ড অব অনার প্রদানের তীব্র প্রতিবাদ জানান!এমনকি তিনি উগ্র ও অশালীন ভাষাও প্রয়োগ করেন বলে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়।
এমন অবস্থায় ইউএনও তাঁর ট্রুপস নিয়ে একপর্যায়ে ফেরতও চলে আসেন।
---- ঐ বিষয়ে মন্তব্য একেবারেই নিষ্প্রয়োজন!
পৃথিবীর সকল নারী শ্রমিক আর মেহনতি মানুষের জন্য আজ আমার মে-দিবসের রক্তিম শুভেচ্ছা।ধন্যবাদ!