ভৌতিক কাহিনী

in writingstoryghostindia •  3 years ago 

গা ছমছমে একটি ভূতের গল্প।।
.
তখনও স্কুলের গণ্ডি পার হইনি। বাবা রংপুর থেকে নোয়াখালিতে বদলি হয়েছেন। স্কুল জীবনের বন্ধুত্ব খুবই প্রগার হয়, বুকে কষ্ট নিয়ে এখানকার বন্ধুদের ছেড়ে যাচ্ছি। তার মধ্যে আবার স্টেশনে বাবার জন্য সবাই কান্নাকাটি করছির। সৎ ও নিরপেক্ষ হিসেবে বাবার সুনাম ছিল, তাই সবার মনোকষ্ট, ফলে বন্ধু বিচ্ছেদ ও সবার কান্না দেখে মনটা খুবই খারাপ।
.
যথারীতি যখন নোয়াখালির সোনাপুরে পৌঁছালাম তখন অভ্যর্থনার জন্য লোক সমাবেশ, মালা দিয়ে বরণ বাবা-মাকে, আমার মনটাকে বিশেষ ভালো করতে পারল না। সোনাপুরেই জেলার সব বড় অফিসারদের বাঙলো- ডিসি, এসপি, জেলা জজ, সিভিল সার্জন– সবারই বাংলো- মাঝখানে শান বাঁধানো ঘাটের দীঘি। বাড়িগুলোর দেয়াল বেতের, মেঝে পাকা, ছাদ অ্যাসফারবেটের- সুন্দর চত্বর, বড় গেট। গেট দিয়ে যখন ঢুকলাম তখন ভিন্নধর্মী গৃহ প্যাটার্ন দেখে ভালোই লাগল। একটু রাত হয়েছিল। খাওয়া দাওয়া করতে করতে বেশ রাত হয়ে গেল।
.
ঘুমোতে যাব এমন সময় মনে হল ছাদের পাটাতনে কে যেন কাউকে কোড়ার চাবুক মারছে, আর অজানা সেই মহিলা আর্তচিৎকার করছে- চমকে উঠলাম। শুধু যদি আমি শুনতাম তবে হয়তো বলবার ছিল, ভুল শুনেছি। কিন্তু না! শুধু আমি নই, বাড়িসুদ্ধ সবাই শুনেছে। আর সবাই ঘরের পাটাতনে একই শব্দ শুনতে পেয়েছে। আটজন গার্ড বাইরে পাহারা দিচ্ছিল, বাবা ওদের জিজ্ঞেস করলেন ব্যাপারটা কি? তারা উত্তরে বলল যে, কে বা কারা এমনটি করছে তাদের জানা নেই। বাবা সাহসী দেখে দুইজন গার্ডকে ছাদের পাটাতনে উঠিয়ে দিলেন দেখবার জন্য। তারা বলল এর আগেও দেখেছে, কিছু চিহ্ন মাত্র পাওয়া যায়নি। এবারও উত্তরটা একই হলো। ঘটনার এখানেই কিন্তু শেষ নয়। এরপর শুয়ে পড়ি যার যার বিছানায়, যার যার ঘরে।
,
রাত তখন দুটোর কম হবেনা। মনে হলো যেন ঘাড়ের কাছে কারও নিঃশ্বাস ওঠানামা করছে। গলায় যেন কার ঠান্ডা হাত অনুভব করলাম। আমার মেজো বোনটা চিরকালই ভীতু। সে ভয়ে উঠে এল আমার বিছানায়, নিজের ঘর ছেড়ে। বলল, আমি তোর সাথে ঘুমাব। আমি বুঝলাম সে কেন এ প্রস্তাব দিল। ওকে বুঝতে দিলাম না তা। বললাম বেশ থাকো তুমি। যত দোয়া দরূদ আমার জানা ছিল তা পড়ে, বুকে ফু দিয়ে ঘুমিয়ে গেলাম। সকাল হলো। নামাজ পড়ে দেখলাম মা উঠান পেড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছেন। বাবুর্চি চাচা অনেক আগেই এসে গেছেন। ছোটো আপা অর্থাৎ আমার মেজোবোন অঘোরে ঘুমাচ্ছে। মাকে কিছু বললাম না। এভাবে কিছুদিন কেটে গেল। একই ঘটনা বলা যায় প্রায় প্রতিদিনই ঘটতে লাগল। একদিন রাতে এমনটি ঘটবার সময় মনে হলো, কে যেন ঠান্ডা হাত দিয়ে গলার চিকন হাড়টা খুলে নিল। রাতের বেলায় বিছানা ছেড়ে উঠে দেখার চেষ্টা করলাম না। তবে মনে মনে বুঝলাম বাংলোর বাইরে আটজন গার্ড পাহারা দিচ্ছে, সুতরাং চোর ঢুকেছে একথা কোনমতে বিশ্বাস করা যায় না।
সকালে আজানের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। বিছানা থেকে পা নামাতেই মনে হল কিসে যেন পা ঠেকল। নিচে চেয়ে দেখি কার্পেটের উপর আমাদের দুবোনের গলার চিকন হাড় দুটো পড়ে আছে। অল্প বয়স তার ওপর এমন অস্বাভাবিক ঘটনা। অস্বস্তি যে লাগেনি তখন, এমন কথা স্বীকার না করলে মিথ্যাই বলা হবে। তাই, প্রথম থেকে শুরু করে সেদিন যা ঘটল, মাকে সবিস্তারে বললাম। ছোটো আপা বললে হয়তো মা মনে করতেন তার মনের ভুল, ভীতু তো। আমি বলায় মা বললেন, দেখি কী করা যায়। এইভাবে কয়েক মাস কেটে গেল। এর মধ্যে কোনো কোনো ঘটনা বিক্ষিপ্তভাবে ঘটেছে। এর মধ্যে আমার বাবুর্চি চাচার সাথে বেশ ভাব হয়ে গেছে। বাবুর্চি চাচাকে আমি প্রতিরাতের ঘটনা বলি। উনি মাথা নেড়ে বলেন- হ্যাঁ, বাবুয়া, এসবই সত্যি। এরকম ঘটনা সবই এখানে ঘটে। তখনও আমি বুঝিনি আরও একটা অদ্ভূদ ঘটনা ঘটতে চলছে। তখন শীত এসে গেছে। নানী এসেছেন তার একমাত্র মেয়ে জামাইকে দেখতে। বাবার ছোটো বেলায় তার মা মারা গিয়েছিল বলে নানীকে খুবই ভালোবাসতেন। সে যাই হোক, পরের দিন, বাবা গেলেন ট্যুরে বেগমগঞ্জ। যদিও আমি সাধারণত বাবা কোথাও গেলে সঙ্গ ছাড়িনা, কিন্তু এবার যেহেতু নানি এসেছেন, সেহেতু গেলাম না। শীতের দিন হলেও সন্ধ্যা থেকে একটু টিপ টিপ বৃষ্টি আর বাতাস বইতে শুরু করল।
,
নানী হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। রাত দশটা পার হয়ে গেছে। বাবা বাসায় নেই, শীতের রাত, তখনও টেলিভিশন চালু হয়নি- সবাই যার যার ঘরে শুয়ে পড়েছে আর বোধহয় ঘুমিয়েও পড়েছে। আশ্চর্য ঘটনা হচ্ছে সেদিন ছোট আপা, মা, নানী সবাই অসুস্থ। আয়াকেও ঘুমোতে পাঠিয়ে দিয়েছি, যদিও সে যেতে চাইছিল না। আমি একটা রহস্য গল্পের বই নিয়ে পড়তে বসলাম, নামটা আজ মনে করতে পারছি না। মা বলতেন যে গল্পের বই না পড়লে অনেক কিছুই জানা যায় না, ভাষাও শেখা যায় না। ফলে ছোট থেকেই গল্পের বই পড়ার অভ্যাসটা রপ্ত করে ফেলেছিলাম। সেই অভ্যাসটা আজও থেকে গেছে। সজাগ থাকার জন্য বই পড়া শুরু করলাম। কান সজাগ।
,
বেশ রাত তখন, মনে হচ্ছিল নানি যেন ডাকছেন। উঠে গেলাম তার কাছে। গিয়ে দেখি তিনি অঘোরে ঘুমাচ্ছেন। ভাবলাম কানের ভুল। নানির ঘর থেকে ফিরে আসতে যাচ্ছি- এবার মনে হলো, মা ডাকছেন আমাকে। তাড়াতাড়ি গেলাম মার ঘরে। কিন্তু দেখি তিনিও ঘুমোচ্ছেন অঘোরে। ভাবলাম, ভুল শুনেছি। আবারও ফিরে এসে বিছানায় বসতে যাব, মনে হলো ছোট আপা ডাকছেন। তড়িঘড়ি তার ঘরের দিকে দ্রুত পায়ে এগুলাম। বসা আর হলোনা। অবাক কাণ্ড! দেখি সেও ঘুমাচ্ছে। এই শীতরাতে আমার ঘাম ঝরতে লাগলো। এ হতে পারে না, এতবার আমি কানে ভুল শুনলাম? তা কি করে হয়! এটা একটা অস্বভাবিক ঘটনা, এ কথা মনে হতেই বুকের ভেতরটা কেমন শিরশির করে উঠল। মুরুব্বিদের বলতে শুনেছি- এরকম অবস্থায় ভয় পেলেই ক্ষতি। ওই অবস্থায় মনে হলো, যতই অস্বাভাবিক ঘটনা হোক না কেন, ভয় পেলে চলবে না।
,
তবে মনে যাই বলি না কেন, এটা কেমন জানি এক অস্বস্তিকর অবস্থা। কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারছিনা এই আবেশটা। তখনও জানি না আমার জন্য আরও কী ভয়ঙ্কর ঘটনা অপেক্ষা করছিল। মার আঁচল ধরে ঘুরতে ঘুরতে মার মুখে মুখে শুনে আয়াতুল কুর্সি মুখস্থ করে ফেলেছিলাম। মনে হলো ভাগ্যিস শিখেছিলাম। এর গুণ আর মাহাত্ম্য এমন যে কোনো দুষ্ট-অশুভ কিছু কাছে ভীড়তে পারবে না। দোয়াটা পড়ে বুকে ফুঁ দিলাম। মনে সাহস বাড়ল। নিজের ঘরে গিয়ে মনে হলো আমি খুবই ক্লান্ত, বসে থাকতে পারছি না। একটু টান টান হয়ে নিই। এই চিন্তা করে লেপের ভেতর ঢুকে গেলাম। বার বার উঠতে হতে পারে ভেবে মশারি টাঙাইনি।
খানিক পরেই মনে হলো কে যেন আমার পায়ের কাছে বসল। মনে হলেও উড়িয়ে দিলাম, সবাই অসুস্থ, বাইরে গার্ড, সব দরজা বন্ধ, কেমন করে কেই বা ঢুকবে বাড়ির ভেতরে? এ কথা বলে মনে মনে লেপ দিয়ে ঢাকা মুখ আর খুললাম না। তবে মনের ভেতর থেকে কিন্তু কিছুতেই এই চিন্তা সরাতে পারলাম না, কেউ নিশ্চয়ই বসে আছে পায়ের কাছটায়। এটাই বার বার মনে হতে লাগল, ঠিক তাই! লেপ থেকে মুখ একটু খুলে দেখি যে একজন মহিলা আমার দিকে চেয়ে চেয়ে হাসছে, মাথায় তার ঘোমটা, আমার পায়ের দিকে খাটে বসে তিনি। আমি দেখে মুখটা আবার ঢেকে ফেললাম। না না ভয় পেলে চলবে না, ভয় পেলেই ক্ষতি। ‘আমি ভয় পাব না’ বারবার বলছি আর আয়াতুল কুর্সিসহ যত সুরা-দোয়া জানা ছিল পড়েই যাচ্ছি। শেষে একবার সাহস নিয়ে মারলাম লাথি। কান্তু কিসে যে মারলাম অনুভব করতে পরলাম না। তক্ষুণি মনে পড়ল, অস্বাভাবিক জিনিসদের আকৃতি থাকে, অবয়ব থাকে না।
,
তক্ষুণি হাত পা হিম হয়ে আসতে লাগল। যতই আমি ভয় পেতে থাকি ততই বুকে সাহস আনবার চেষ্টা করি। দোয়া-সুরা পড়ি। লেপ ফাঁক করে চুপ করে দেখতে পাই আমার দিকে চেয়ে মিটমিট হাসছেই মহিলা। আমার ঘরের জানালা, সেই ছোটবেলা থেকেই, কি শীত, কি গ্রীষ্ম, কি বর্ষা, অন্তত একটা হলেও খোলা থাকে। আমার এই ঘরের এই শীতেও একটা জানালা খোলা ছিল। জানালাটা দিয়ে একটা গন্ধরাজ ফুলগাছ দেখা যায়। ওটা লাগাই না এ জন্য যে ফুলের সুবাস ওই জানালাটা দিয়ে ঘরে আসে। মাঝে মাঝেই লেপ একটু ফাঁক করে জানালাটা দিয়ে দেখবার চেষ্টা করছি যদি গার্ডদের কোনও একজনকে দেখতে পাই। এইভাবে দীর্ঘসময় কেটে গেল।
,
অতিক্রান্ত দীর্ঘ সময়টা আমার জন্য ভয়ঙ্কর সময় বলে মনে হচ্ছিল, এমন সময় আজানের ধ্বনি শোনা গেল। অমনি মেয়েটি পায়ের কাছ থেকে উঠে গিয়ে জানালা দিয়ে বেরিয়ে গন্ধরাজ গাছটাতে মিশে গেল। আমি বিমূঢ় বিস্ময়ে চেয়ে থাকলাম ওই অশরীরী মহিলার যাবার পথে। আমাদের মতো মানুষের তো জানালার রড ভেদ করে কিছুতেই যাওয়া সম্ভব নয়। এমন ঘটনা মাকে না বললেই নয়। তাই নামাজ পড়ে মার ঘরে গেলাম। মাকে কিছু খাইয়ে ওষুধ খাওয়ালাম। তার পর ধীরে ধীরে ঘটনাটা খুলে বললাম। মা চুপ করে শুনে গেলেন, কিছু বললেন না।
একটু বেলা হলে মা আর্দালিকে জিজ্ঞেস করলেন তার কোন কামেল ফকিরের কথা জানা আছে নাকি? ডাকলে আসবেন কি না? সে জানাল একজনকে সে চেনে, টাকা পয়সা কিছুই নেয় না। মাঝে মাঝে উনি তার বাচ্চাদের তেলপড়া, পানিপড়া দেন, তাবিজও দেন কিন্তু একটা পয়সাও নেন না। সবারই উপকার হয়। তারা খুশি মনে কিছু দিতে চাইলেও উনি কিছুই নেন না। বলেন, আমি আল্লাহর হুকুমেই আল্লাহর বান্দার সেবা করি, আমি যে কিছুই নিতে পারব না। এমনকী যার চিকীৎসা করেন তার বাড়িতে কিছু খানও না। মা বললেন তার এমনই লোক-ই চাই। ওনাকে খবর দেওয়া হলো। মা তাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য মাফ চাইলেন এবং পুরো ঘটনাটাই ধীরে ধীরে বললেন তাকে। উনি ঘটনা শুনতে শুনতে আমার কপালের দিকে দেখতে লাগলেন। পরে ঘটনাটা যেখানে ঘটেছে সেই ঘরটা দেখতে চাইলেন। আমি তাকে নিয়ে গেলাম আমার ঘরে। উনি জানালাটার কাছে দাঁড়িয়ে গন্ধরাজ গাছটাকে খুব গভীরভাবে দেখতে লাগলেন। তারপর কিছু আমল করে গাছের দিকে ও জানালাটায় ফুঁ দিলেন।
,
ঘুরে আমাকে নির্দেশ দিলেন, এশার নামাজের সময় যেন আমি জানালাটা লাগিয়ে রাখি আর ফজরের নামাজ পড়বার সময় যেন খুলে দেই। যদি কেউ জানালায় টোকাও দেয়, তাও যেন না খুলি। মার কাছে ফিরে গেলেন তিনি। বললেন, মেয়ে ভয় পেলে ক্ষতি হত, আল্লাহর কালামের বরকত। ওইখানে ওই গাছের নিচে একটা মেয়েকে খুন করে পুঁতে রেখেছিল কোনো এক মানুষ- এখন সেই দেহ মাটির সাথে মিশে গেছে। এই বলে তিনি চলে গেলেন। আমরা সবাই হতভম্ভ হয়ে বসে থাকলাম। বাবা বেগমগঞ্জ থেকে ফিরে এলেন। বাবাকে আমি সমস্ত ঘটনা খুলে বললাম। বাবা শুনে গেলেন মন দিয়ে, শুধু বললেন, উনি যা বলেছেন , তা ঠিক ঠিক মতো মেনে চলো। তারপর প্রতিদিনই জানালায় টোকা শুনতাম, কিন্তু জানালা আর খুলিনি এশার পর। আর কিছু ঘটেওনি- তবে ছাদের পাটাতনে কোড়া মারবার শব্দ আর আর্তচিৎকার অব্যাহতই ছিল। কিন্তু শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ আর গলায় ঠান্ডা হাতের স্পর্শের ঘটনা আর ঘটেনি। কিন্তু আমি ত্রিশ বছর আগে এমএ পাশ করে প্রায় ত্রিশ বছর অধ্যাপনা করার পরেও-ঘটনার কথা ভুলতে পারিনি।

pexels-elina-krima-3319333.jpg

Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!