অপ্সরা

in writter •  7 years ago 

মনোয়ার সাহেব কিছুতেই তার মেজাজ কন্ট্রোলে রাখতে পারছেন না। রাগী মানুষেরা হলো পৃথিবীর সবচেয়ে অভাগা সম্প্রদায়। তারা নিজেদের রাগের ওপর নিজেরাই নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেন না! আশেপাশের মানুষদের নিয়ন্ত্রণে রেখে রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। অন্যের দয়ার ওপর বেঁচে থাকা আর কী! অন্যরা যখন অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়, তখন চেয়ে-চেঁচিয়ে রাগা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না।
সকাল থেকেই প্রেশারে সমস্যা করছে। তাই বসকে বলে মনোয়ার সাহেব আজকের দিনের জন্য ছুটি নিয়েছেন। তিনি যে প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করেন, সেটি ব্যক্তিমালিকানাধীন একটি দেশীয় প্রতিষ্ঠান। সেখানে ছুটি পাওয়া ঠিক যেন তার টাইপের মানুষের নিজের রাগ কন্ট্রোলে রাখার মতোই কঠিন কাজ। অনেকদিন ছুটিছাটা নেননি; তাই অসুস্থতার কথা বলাতে আজকের ছুটি পেতে খুব একটা সমস্যা হয়নি।
মনোয়ার সাহেব একই কোম্পানিতে দীর্ঘ দুই যুগ কাজ করেও শুধুমাত্র তার বদমেজাজের কারণেই এখন পর্যন্ত একই পদে আছেন। বেতনও খুব একটা বাড়েনি। সব মিলিয়ে এখন তেত্রিশ হাজার পান। বাড়ি ভাড়াতেই চলে যায় অর্ধেক। টেনেটুনে সংসার চলে। গ্রামের জমিজমাগুলো থেকে আয় না আসলে ঢাকা শহরে সংসার চালানোই তার জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ত।
অন্যদিকে, মিসেস মনোয়ার অর্থাৎ তারানা একদম ঠাণ্ডা মেজাজের মানুষ। তারানা না হয়ে অন্য কেউ স্ত্রী হলে মনোয়ার সাহেবকে তার রাগের সঙ্গেই সংসার করতে হতো! এদিক থেকে মনোয়ার সাহেব বেশ সৌভাগ্যবান বলা যেতে পারে।
ইদানিং মনোয়ার সাহেবের মেজাজ এভারেস্টের চূড়ায় চড়েই থাকে। তার কারণ, একদম পাশের বাড়িটাই ভাঙার কাজ চলছে। ভোর থেকেই শুরু হয় স্লেজ হাতুড়ির দ্রিম দ্রিম আওয়াজ। মানোয়ার সাহেবরা থাকেন তিনতলায়। আর পাশের বাড়িটাও তিনতলা। স্লেজ হাতুড়ির উপর্যুপরি আঘাতে মনোয়ার সাহেবদের বিল্ডিংও কেঁপে কেঁপে ওঠে। সকালে তার ঘুমই ভাঙে চরম বিরক্তি নিয়ে। অফিসে যাওয়ার আগ পর্যন্ত মেজাজ লাফিয়ে লাফিয়ে গরম হতে থাকে।
মনোয়ার সাহেবের শব্দের প্রতি অ্যালার্জি আছে। শব্দ তার সবচেয়ে বড় শত্রু। যদিও রাতে বাড়িভাঙার কাজ বন্ধ থাকে; কিন্তু ইদানিং তিনি রাতে ঘুমের মধ্যেও স্বপ্নে দেখেন তার মাথার ওপরে শব্দবোমা ফাটছে! স্বপ্নের একপর্যায়ে পটকা-আতশবাজি ফুটতে আরম্ভ করে, জাতিসংঘের মহাসচিব কেমিক্যাল বোমার পাশাপাশি সাউন্ড বোমা নিয়েও বিবৃতি দেওয়া শুরু করেন, সুশীলগণ গোলটেবিল বৈঠকে শব্দদূষণ কমাতে করণীয় কী - তা নিয়ে শোরগোল করতে থাকেন, সেখানেও শব্দ - উফ!
আর সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে তো সারাটা দিন অশান্তি! সবজিওয়ালার চিৎকার, মুরগিওয়ালার চেঁচামেচি, কাগজওয়ালার স্লোগান, রিক্সা-ভ্যানের টুংটাং কিংবা বাড়িভাঙার ধুমধাম আওয়াজ লেগেই আছে!
আজ সকাল থেকেই বৃষ্টি শুরু হওয়ায় বাড়ি ভাঙাভাঙির শব্দ নাই। কিন্তু অন্য একটি কারণে মনোয়ার সাহেব চরম হাইপার হয়ে আছেন। ঘাড়ের পেশীগুলো এঁটে আসছে। এক কথায়, তিনি রেগে ঢোল হয়ে আছেন। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তাই বলে ঘর-সংসার ছেড়ে চলে আসতে হবে?’
মেয়ের মেজাজ হয়েছে বাপের চেয়েও এক কাঠি সুরেশ (সুরেশ সরিষার তেলের মতো ঝাঁজযুক্ত)! বাবার প্রশ্ন শুনে সেও সরিষাবেগুনে জ্বলে উঠল, ‘তো কী করব? জানোয়ারটা অন্য মেয়ের সঙ্গে প্রেম করবে আর আমি ঘরে বসে ধেইধেই করে নাচব? আমি তো আর বন্যার পানিতে ভেসে আসিনি।’
সাধারণত রাগী মানুষেরা হয় একরোখা। আর একরোখা মানুষমাত্রই নির্বোধ। কিন্তু মনোয়ার সাহেবের কথার মধ্যে মাঝেমাঝে লজিক খুঁজে পাওয়া যায়। তিনি বললেন, ‘কিন্তু সংসারের সমস্যা সংসারের মধ্যে থেকেই সমাধান করতে হয়। সংসার থেকে বেরিয়ে গিয়ে তার সমাধান করা যায় না।’
‘তোমাকে কে বলল যে আমি সমাধান করতে চাচ্ছি? ওই বদমাশ পরকীয়ার লাড্ডু খেয়ে বেড়াবে আর আমি বসেবসে শান্তির রোডম্যাপ তৈরি করব? আমি রকির সঙ্গে আর সংসার করব না।’
তারানা নিশ্চুপ হয়ে বাপ-মেয়ের কথাবার্তা শুনছেন। কিছুক্ষণ আগে তাদের বড় মেয়ে সিঁথি বাপের বাড়িতে চলে এসেছে; একেবারে তল্পিতল্পাসহ! তারানা ভেবেছিলেন, মা হওয়ার সময় মেয়েরা তাদের মায়ের কাছে থাকতেই স্বস্তিবোধ করে; তাই হয়তো মেয়ে চলে এসেছে। কিন্তু মেয়ের মুখে এই টাইপের কথাবার্তা শুনে তিনি চুপসে গেলেন। মেয়েটি আগেও এমন পাগলামি করেছে; কিন্তু আজ তার কথা বলার ঝাঁজ আর চেহারা দেখে মায়ের মন অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল!
বড় মেয়ে সিঁথির প্রেমের বিয়ে। তাই বিয়ের সময় বেশ ঝক্কি পোহাতে হয়েছে। সেসময় তারানা মেয়ের পক্ষ নিয়ে স্বামীকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বিয়েতে তার সম্মতি নিয়েছিলেন। সেই মেয়ের সংসারের এখন এই দশা! মেয়ে সংসার করতে চাচ্ছে না শুনে তারানা বললেন, ‘তুই মনে হয় রকিকে ভুল বুঝছিস, সিঁথু!’
সিঁথি কোনো কথা না বলে হ্যান্ডব্যাগ থেকে একটি মোড়ানো টিস্যুপেপার বের করল। টিস্যুপেপারের ভাঁজ খুলে সেখান থেকে একটি চুল বের করে দেখিয়ে বলল, ‘এই চুল ওর শার্টে ছিল! এরপরও বলো ওকে বিশ্বাস করতে?’
তারানা চুলের দিকে ঠিকমতো তাকালেনও না। তিনি বললেন, ‘একটা চুল দেখেই তো সন্দেহ করা ঠিক না, সিঁথু। রাস্তা দিয়ে চলার সময়ও তো কোথাও থেকে চুলটা উড়ে এসে ওর শার্টে পড়তে পারে।’
‘ঠিক একই রকম চুল আমি কয়েকদিন আগেও ওর পোশাকে পেয়েছি। তখন তোমার মতো চিন্তা করেই এড়িয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু এখন এটাকে আর ইগনোর করার কোনো কারণ দেখছি না। দুশ্চরিত্র মানুষের সঙ্গে ঘর করার চেয়ে শূন্য ঘর ভালো।’
তারানা মেয়ের কথার শুনলেন কিনা বোঝা গেল না। তিনি বললেন, ‘আমিও তো মাঝেমাঝে চিরুনি থেকে চুল ছাড়িয়ে বারান্দা দিয়ে নিচে ফেলি। সেটা তো কারও গায়ে গিয়েও পড়তে পারে!’
‘মা, তোমরা আমাকে লেখাপড়া না শেখালেই মনে হয় ভালো করতে! ওসব ভংচং দিয়ে আমাকে বোঝানো সম্ভব না।’
তারানা চুপ হয়ে গেলেন। রাগী মানুষের সঙ্গে তাদের রাগের মুহূর্তে কথা বলা মানেই ক্ষতি। বাপ-মেয়ে একই ধাঁচের। আরও একটা বিষয়ে বাপ-মেয়ের মিল আছে। দুজনে যেমন চট করে রেগে যায়; তেমনি চট করে তাদের রাগ পড়েও যায়। পরে মেয়ে ঠাণ্ডা হলে তিনি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করবেন। তখন ফ্যামিলি ক্রাইসিস মেটানোর চেষ্টা করা যাবে; আপাতত রাগসংকট কাটুক!

writter @fabel1

Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!